Advertisement
০৭ মে ২০২৪

আলোয় ভরা অর্ধেক আকাশ

এক বার বাড়ি এসে গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শোনে কন্যাশ্রী প্রকল্পের কথা। তারপরই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু। ২০১৬ সালে আবার স্কুলে ভর্তি হয়।

প্রেরণা: মায়ের কোলে কন্যাশ্রী দিবসের স্বীকৃতি নিতে এসেছে ধূপগুড়ির মুক্তা খাতুন। শুক্রবার জলপাইগুড়িতে। ছবি: সন্দীপ পাল

প্রেরণা: মায়ের কোলে কন্যাশ্রী দিবসের স্বীকৃতি নিতে এসেছে ধূপগুড়ির মুক্তা খাতুন। শুক্রবার জলপাইগুড়িতে। ছবি: সন্দীপ পাল

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৭ ১১:২০
Share: Save:

অনিন্দিতা সাহা

ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর এক দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। সংসারের চাকাটাকে সচল রাখতে পরিচারিকার কাজ নিতে হয়েছিল। সেই অনিন্দিতাই কন্যা রত্ন সম্মান পেলেন মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে। তারপরেই নেতাজি ইন্ডোরের ম়ঞ্চে দাঁড়িয়ে স্কুলে ফেরার গল্প শোনালো আলিপুরদুয়ার ১ ব্লকের চকোয়াখেতির বাসিন্দা অনিন্দিতা সাহা।

সাত ভাই-বোনের সংসারে প্রবল অনটন। তাই পড়াশোনা ছেড়ে কোচবিহারে এক বাড়িতে কাজ নিয়েছিল। সেটা ২০১২ সাল। সেখানে সকাল হলেই ছোটরা রওনা হত স্কুলের পথে। তাদের দেখে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে হতো তারও। অনিন্দিতা বলে, ‘‘ওদের বলেওছিলাম পড়াশোনার কথা। শুনতে হয়েছিল, পড়তে টাকা লাগে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’’ ছয় মাস পরপর নিজের গ্রামে ফিরত অনিন্দিতা। এক বার বাড়ি এসে গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শোনে কন্যাশ্রী প্রকল্পের কথা। তারপরই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু। ২০১৬ সালে আবার স্কুলে ভর্তি হয়।

তার কথায়, ‘‘সোনারপুর বিকে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন। বয়স বেশি হওয়ায় আমাকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি নেয়। এই বছর ক্লাস এইটে উঠেছি। খুব ভালো লাগছে। আমি চাই সবাই পড়ুক।’’

বিউটি খাতুন

চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ইংরেজবাজার ব্লকের অমৃতি গ্রাম পঞ্চায়েতের নাদাবপাড়া গ্রামে প্রতিবেশীর বৌভাতের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বিউটি খাতুন। গিয়ে জানতে পারে নববধূ নাবালিকা। বৌভাতের আসরেই প্রতিবাদ করে ১৬ বছরের কিশোরী। আর তারই জেরে আক্রান্ত হতে হয় তাকে। বিউটিকে মারধরের অভিযোগ ওঠে এক মোড়লের পরিবারের ৬ জনের বিরুদ্ধে। মারধরে জখম হয়ে বেশ কয়েক দিন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয় বিউটিকে।

ওই প্রতিবাদী সত্তার জন্য মেয়েটিকে কুর্নিশ জানিয়ে মালদহ জেলা প্রশাসন নাবালিকা বিয়ে বন্ধের প্রচারে তাকে জেলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে। এরপরেও বিউটিকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ উঠেছিল এলাকারই কয়েক জন যুবকের বিরুদ্ধে। মাসখানেক আগের সেই ঘটনার জেরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিউটির। বিষয়টি নিয়ে জেলার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কাছে অভিযোগ জানায় বিউটি। তারা ব্যবস্থা নেওয়ায় এখন স্কুলে যাচ্ছে সে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা প্রাপক বিউটিকে শুক্রবার কন্যাশ্রী দিবসে সংবর্ধনা দিল মালদহ জেলা প্রশাসন।

মঞ্চে উঠে জেলা প্রশাসনের কাছে এ দিন বিউটি আর্জি জানায়, হস্টেলে রেখে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক তাকে।

হৈমন্তী বর্মন

পাড়ায় দেখেছে দিনের বেলাতেও জ্বলে থাকে পথবাতি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, যে ব্যক্তি পথবাতি জ্বালানো-নেভানোর দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিদিন আসেন না তিনি। তার এলাকায় ১৬টি পথবাতি দিনভর জ্বলে থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুতের অপচয় করে তা দিয়ে কত পরিবারে আলো জ্বালানো যেতে পারত, তা হাতে কলমে দেখায়। প্রস্তাব দেয় টাইমারের। কারণ টাইমার লাগানো থাকলে বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে। শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া হাতিয়াডাঙার বাসিন্দা হৈমন্তীর সেই মডেল প্রশংসিত হয় কলকাতায় শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসে।

শিলিগুড়ি নেতাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী হৈমন্তী। দিন মজুর বাবা কোনও দিন ধান, কোনও দিন পাটের খেতে কাজ করেন। সেলাইয়ের কাজ করেন মা। মেয়ের তৈরি বিজ্ঞানের মডেল প্রশংসিত হয়েছে রাজ্য জুড়ে। শুক্রবার শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে মন্ত্রী-আমলাদের উপস্থিতিতে তার নাম ডাকা হয় মাইকে। ঘন ঘন ফ্ল্যাশ বাল্‌বের আলো, হাততালি। মেয়ের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার দৃশ্য দেখে অডিটোরিয়ামের একেবারে পেছনের সারির চেয়ারে বসে থাকা মায়ের চোখে জল। ‘‘মেয়েটা আমার খুব লাজুক। কিন্তু বড্ড জেদি। এই জেদেই ভাঙা টিনের চালের বাড়ি থেকে মঞ্চে পৌঁছতে পারল।’’

বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়র হতে চায় হৈমন্তী। জানে লড়াইটা কঠিন। শুক্রবারের সংবর্ধনা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে কন্যাশ্রী হৈমন্তীর।

টুসি খাতুন

পরিবারের সকলেই বিড়ি বাঁধেন এবং তাতেই চলে সংসার। দুই ভাই-বোনের লেখাপড়াও। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২৫ হাজার টাকা পেয়েছিল কালিয়াচক ৩ ব্লকের ভগবানপুরের টোট্টুটোলার ওই পরিবারের অষ্টাদশী টুসি খাতুন। বাবা-মা ভেবেছিল ওই টাকায় টুসির বিয়ে দেবেন। পাত্রও খোঁজা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বেঁকে বসে টুসি। বাবা-মাকে সাফ জানিয়ে দেয়, লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। চাকরি করবে।

কন্যাশ্রীর ওই টাকা থেকে দু’হাজার টাকা নিয়ে সে মালদহ কলেজে ভর্তি হয়। শুধু তাই নয়, ওই টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে একটি গরুও কেনে যাতে দুধ বিক্রি করে সংসার কিছুটা ভাল ভাবে চলে। এ ছাড়া বাবার হাতে তুলে দেয় সাত হাজার টাকা। সেই টাকা গিয়ে বাবা জমিতে লঙ্কা চাষ করেছেন এবং তা বাজারে বিক্রিও করছেন। বিয়েতে রাজি না হয়ে কন্যাশ্রীর টাকা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতে শুক্রবার কন্যাশ্রী দিবসে টুসিকে সংবর্ধনা জানাল মালদহ জেলা প্রশাসন।

এ দিন মেয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন আরশাদ আলি। তিনি বলেন, ‘‘মেয়ে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় আমরা আর ওকে কোনওরকম চাপ দিইনি। এখন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ও।’’

আলেমা খাতুন

প্রতিবাদটা শুরু হয়েছিল নিজের বিয়ে ভেঙে। আত্মীয়দের চাপ উপেক্ষা করে নিজের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের কামাত চ্যাংরাবান্ধার তরুণী আলেমা খাতুন। এখানেই থেমে থাকেনি। নিজের ছয় বান্ধবীর বিয়ে ভেঙে দিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এখন নিয়ম করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাবালিকা বিয়ে বন্ধে জনমত গড়ে তুলছে আলেমা।

সংখ্যালঘু পরিবারের সেই মেয়েই এখন নাবালিকা বিয়ে বন্ধে প্রধান মুখ হয়ে উঠেছে কোচবিহারে। শুক্রবার সংখ্যালঘু পরিবারের ওই মেয়ে আলেমাকেই কন্যাশ্রী সম্মান জানাল কোচবিহার জেলা প্রশাসন। হাতে পুরস্কার নিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে চ্যাংরাবান্ধা হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী আলেমার। তাঁর কথায়, “আমাদের যখন খেলার বয়স, যখন পড়াশোনার বয়স, তখনই আমাদের বিয়ে দিতে তোড়জোড় শুরু হয়। অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে কত কিশোরীর মৃত্যু হয়। এর বিরুদ্ধে যতদিন জীবন থাকবে লড়ে যাব।”

বাবা প্রতিবন্ধী। মা চা বাগানে কাজ করে। মজুরির টাকাতেই কোনও মতে চলে তাদের সংসার। সেখান থেকেই স্বপ্ন ছোঁয়ার লড়াই জারি আলেমার।

মুক্তা খাতুন

মায়ের কোলে চেপে মেয়েটি সবে মঞ্চে উঠেছে৷ আর তখনই গোটা হল ঘর ভরে গেল করতালিতে৷ সবাই দাড়িয়ে উঠে কুর্নিশ জানালেন মেয়েটিকে৷ ধূপগুড়ির পশ্চিম ডাউকিমারিতে বাড়ি মুক্তা খাতুনের৷ জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী মুক্তা৷ উচ্চতা আড়াই ফুট বা তার একটু বেশি হবে৷ হাত-পা বাঁকা৷ নিজে নিজে চলাফেরাও করতে পারে না৷ কথাতেও রয়েছে জড়তা৷ এমন একটি মেয়ে পড়াশোনা করতে পারবে না ভেবে প্রথমদিকে তাকে স্কুলেও ভর্তি করাননি বাবা-মা৷ পরে কখনও মায়ের কোলে তো কখনও বোনের কোলে চেপে স্কুলে গিয়েছে৷ ডাউকিমারি দীননাথ হাই স্কুলে ২৪৮ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক ও ২৩৭ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এ বছরই ধূপগুড়ি গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি৷ রাইটারের সাহায্যে পরীক্ষা দিয়েছেন মুক্তা৷ তাঁর কথায়, ‘‘পড়াশোনা আমি চালিয়েই যাব৷ বড় হয়ে সরকারি চাকরি করব৷ তারপর বাবা-মা-কে দেখব৷’’

মুক্তার বাবা মকবুল কৃষিকাজ করেন৷ মা জামিনা খাতুন গৃহবধূ৷ কিছু দিন আগে কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২৫ হাজার টাকা পেয়েছেন মুক্তা৷ আর পাওয়ার পর বাবাকে সে বলে বাড়িতে শৌচাগার গড়তে৷ শুক্রবার জলপাইগুড়তে কন্যাশ্রীর অনুষ্ঠানে মুক্তাকে পুরস্কৃত করল জেলা প্রশাসন৷

প্রতিবেদন: নারায়ণ দে, নমিতেশ ঘোষ, অনির্বাণ রায়, জয়ন্ত সেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE