পাখি-প্রাঙ্গণ: (বাঁ দিকে) ওরিয়েন্টাল পায়েড হর্নবিল, (মাঝে) ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল, (ডান দিকে) উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আগ্রহে পাখি দেখায় উৎসাহ বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের। নিজস্ব চিত্র
জগদীশ জানতেন, ডাক যখন শুনেছেন, তখন সে পাখি নিশ্চয়ই কোথাও আছে।
কলকাতা থেকে দার্জিলিং পাহাড়ে গিয়েছেন জগদীশ। যেখানে ডাক শুনে পাখির খোঁজ করছেন। রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্ন, ‘রোস্ট হয়? বলি, রোস্ট করে খাওয়া যায়?’
সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার এই দু’টি চরিত্র। পাখির বন্ধু আর পাখির শত্রু। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জলাশয়, বনে পাখি শিকারিদের দাপটে পরিযায়ী হাঁসদের আসা কমেই গিয়েছে। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে তা দেখা গিয়েছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জগদীশেরাই দলে ভারি। জগদীশের মতোই ডাক শুনে পাখি দেখা, পাখি চেনার চেষ্টা করছেন জেতা সাংকৃত্যায়ন, সুবোধকুমার যশ, আনন্দ মুখোপাধ্যায়, নিখিলেশ রায়, সুষমা রোহাতগী, অলক মজুমদারের মতো অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। এই তালিকায় রয়েছেন প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অনির্বাণ মিশ্র, কিউরেটর ফজলুর রহমান এবং তাঁদের অনুগামী পড়ুয়ার দল। তাঁরাও ওই ডাক শুনে পাখির খোঁজ করেন। যেমন ‘ঠক ঠক ঠক’ আওয়াজটা ছড়িয়ে পড়ছিল চার পাশে। গাছের গায়ে প্রায় লেপ্টে বসে আছে কালো ও সোনালি ডানার পাখিটি। জারুল গাছের পাতার আড়ালে নজরে পড়ে চোখের উপর-নীচে ও গলায় হলুদ ছোপ নিয়ে নিশ্চিন্তে ছোট আকৃতির দু’তিন জোড়া। আর জলাশয়ের ধারে মাছের অপেক্ষায় ঠায় বসে আছে মাছরাঙা।
আবার, দিন নেই রাত নেই, থেকে থেকে ডেকে চলে পাখিটা—পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা। অতি সন্তর্পণে শাটার টিপলেন এক অধ্যাপক। ক্যাম্পাসে বহু বর্ণের বিচিত্র অতিথিরা এখন অনেকেরই মন কাড়ছে। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ৩৩০ একর জায়গা জুড়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা থেকে ব্যস্ততম জনবহুল শিবমন্দির এলাকা। জাতীয় সড়কে যানবাহনের অবিরাম যাতায়াত আর হর্নের ঠেলায় কান পাতাই দায়! কিন্তু এই দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা ছুঁয়ে ৩ নম্বর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে সে এক অন্য ছবি, অন্য জগৎ। পায়ে পায়ে যত ভিতরে সেঁধোনো যায়, চোখের সামনে ততই কদম, জারুল, শাল, শিরীষের সবুজের সমারোহ। চৌহদ্দিতেই বয়ে চলেছে নদী—নাম মাগুরমারি। রয়েছে একাধিক জলাশয় এবং উত্তর-পশ্চিমে চা-বাগান আর রাবার প্ল্যান্টেশন। মনোরম এই প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে পাখিদের বর্ণিল সমাবেশ। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই দল বেঁধে আসে বসন্তবৌরি, বাঁশপাতি, দোয়েল, ময়না। টিয়ার ঝাঁক। ক্যাম্পাসের গাছ থেকে গাছে আশ্রয় নেয় এই সব পাখি।
বেনেবৌ ইষ্টিকুটুম ডাহুক গুড়িয়াল কাঠঠোকরা কোকিল পাপিয়া চন্দনার ডাকে সর্ব ক্ষণ মুখরিত ক্যাম্পাস চত্বর। বার্ড ওয়াচিং-এর নেশায় কেউ সাত সকালে বেরিয়ে পড়ছেন বায়নোকুলার আর ক্যামেরা কাঁধে। কেউ আবার একই নেশার টানে বিকেলের দিকে—পাখিদের ঘরে ফেরার শেষবেলায়। অধ্যাপক জেতা সাংকৃত্যায়ন জানালেন, ‘‘সূর্য ওঠার বেশ কিছু ক্ষণ আগেই বেরিয়ে পড়ি, কারণ তখন পখিরা বাসাতেই থাকে, খাবারের খোঁজে তখনও বেরোয়নি। সঙ্গে নিই জুম লেন্স-সমেত ক্যামেরা আর ট্রাইপড।’’
৩ নম্বর গেটের হাত কয়েক দূরেই গেস্ট হাউস। তার সামনের বাগানে যখন-তখন উড়ে এসে জুড়ে বসে বহু কাঠঠোকরা। ২ নম্বর গেটের কাছে রবীন্দ্রভানু মঞ্চ-সংলগ্ন জলাশয়ের পাশের সারি সারি শুকনো গাছও কাঠঠোকরাদের আশ্রয়স্থল। গেস্ট হাউস থেকে ব্যাঙ্কে যাওয়ার পথে ডানহাতি মাটির রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলেই দু-দু’টি জলাশয়। সেখানে ভেসে বেড়াতে দেখা যায় লেসার হুইসলিং ডাক-দের। সাদা বাংলায় যাদের আমরা বলি, ‘সরাল-সরালী’।
৩ নম্বর গেট পেরিয়ে, গেস্ট হাউস ছাড়িয়ে ডানহাতি রাস্তা ধরে এগোলে দু’পাশে রয়েছে মেয়েদের জন্য ‘রানি ভবানী হোস্টেল’ আর ‘নিবেদিতা হোস্টেল’। এ দুটো ছাড়ালে ল’ মোড়। মোড় পেরিয়ে হাত কয়েকের মধ্যেই বাঁ দিকে আবার সরোজিনী হোস্টেল ও পুণ্যেশ্বরী হোস্টেল। এর গা ঘেঁষেই বয়ে চলেছে মাগুরমারি নদী। দক্ষিণ দিকে জাতীয় সড়ক পেরিয়ে সে মিশেছে লচকা নদীতে। নদীর ধারে হোয়াইট থ্রোটেড কিং ফিশার, পায়েড কিং ফিশার, কখনও স্টর্ক-বিলড কিং ফিশারও দেখা যায়। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy