কাজের আর্জি নিয়ে ছিন্নদা রায়। নিজস্ব চিত্র।
একটা কাজ দেবেন? কাজ আছে কোনও? প্রশ্ন একটাই। নতুন কাউকে দেখলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটাই জিজ্ঞেস করেন বৃদ্ধা। মঙ্গলবার সকালে এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এলাকায় গিয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের খোঁজখবর নিতে। তাঁকে গিয়েই শুধোলেন বৃদ্ধা, “একটা কাজ দেবেন?” অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী জানালেন, তাঁর হাতে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা বললেন, “আজকাল কেউ তো কাজে ডাকে না।”
বৃদ্ধা গতকাল খেয়েছেন আতপ চালের ভাত এবং পাট শাক। এ দিন ছিল সেদ্ধ ভাতের সঙ্গে ঢেকি শাক। আগামিকাল ভাতের সঙ্গে কী থাকবে, জানেন না ছিন্নদা রায়। মাঠে গিয়ে যে শাক পাবেন, তুলে আনবেন। রেশনের আতপ চাল দিয়ে ভাত রাঁধেন। রেশের আটা একে ওকে দিয়ে তেল, নুন, মশলা জুটে যায়। মাঠ থেকে শাক তুলে নিয়ে তা দিয়ে কোনওরকমে ভাজা বা সাঁতলে নেওয়া যায়। গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকায় নয়, ছিন্নদা রায়ের এমন জীবনযাত্রা চলছে জলপাইগুড়ি শহরের বুকে।
জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনের পাশেই জয়ন্তী পাড়ার কলোনি। সেখানেই টিন দিয়ে তৈরি একটি ঘরে থাকেন সত্তর বছরের ছিন্নদা। দেড় বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। স্বামী অনিল রায়ও দিনমজুরের কাজ করতেন। ছিন্নদাও ঢালাইয়ের কাজে জোগানদারের কাজ করতেন। গত বছর লকডাউনের পরে নিয়মিত কাজে ডাক পাননি। বিল দিতে পারেননি বলে বছরখানেক আগে বিদ্যুত কেটে দিয়েছে দফতর। আশপাশের বাড়ি থেকে মোম দেয়, সেটা জ্বালিয়েই সন্ধ্যাটুকু কেটে যায়। বাড়িতে শৌচাগার নেই। বাড়ির হালও খারাপ। টিনের চালে অজস্র ফুটো ফাটা। বিছানার চাদর শতছিন্ন। প্রখর রোদের দিন থেকে বৃষ্টি-বাদলার রাত একবেলা ভাত খেয়ে অন্ধকার কুঠরি ঘরেই কাটছে বৃদ্ধার।
রান্না যে টুকু করেন তা দুপুরের জন্য, রাতে জল মুড়ি খেয়ে থাকেন, জানালেন বৃদ্ধা। কারণ? দরিদ্রসীমার নীচে থাকা বাসিন্দারা মাসে যে চাল-আটা পান, ছিন্নদা তা পান না। কারণ সেই কার্ড তার নেই। তিনি চাল আটা মিলিয়ে মাসে পাঁচ কেজি খাদ্যশস্য পান। ২ কেজি চাল, ৩ কেজি আটা। তা দিয়ে দু’বেলা ভাত হবে না, রাতের বেলা তাই জলমুড়ি। ছিন্নদা বলেন, “আগে রেশন থেকে বেশি চাল পেতাম। তারপর হঠাৎ একদিন আমাকে রেশন কার্ডে বড়লোক করে দিল। তারপর থেকে কম পাই।” যে কার্ডে খাদ্যশস্য কম ছিন্নদা-র ভাষায় সেই কার্ড ‘বড়লোক কার্ড’।
কোভিড পরিস্থিতিতে বহু সংগঠন দুঃস্থ মানুষদের সাহায্য করছে। ছিন্নদা বলেন, “আমি কোনও সাহায্য পাইনি। সাহায্য চাই না। একটা কাজ চাই।” কোভিড পরিস্থিতিতে কাজ হারা মানুষদের কাজ দেওয়ার কোনও সরকারি প্রকল্প নেই বলে প্রশাসন দাবি করল। উল্টে বিধি নিষেধ চলায় বেসরকারি কাজের সুযোগও কমেছে। তাই মাত্র একবেলা সরকারি আতপ চালের ভাতের সঙ্গে মাঠ থেকে তুলে আনা শাকের ভাজা মুখে তুলতে হয় ছিন্নদার, এবং সন্ধ্যা জল-মুড়ি। আর তল্লাটে কাউকে নতুন দেখলেই ছুটে গিয়ে জানতে চান, “কোনও কাজ আছে? একটা কাজ পাওয়া যাবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy