Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
বেপরোয়া স্কুলবাস, বাড়ছে ক্ষোভ

আদরের দীপুকে আঁকড়ে ধরল পাড়া

একটা বেপরোয়া স্কুলবাস ওলটপালট করে দিল বণিক পরিবারের সব কিছু। শুক্রবার আদালতের অস্থায়ী করণিক পদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল দীপঙ্করের। সকালে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ঠিকাদারের অধীনে আর বিকালে এটিএমে টাকা ভরার সংস্থার রাতদিন খেটে সংসারের ভার বইছিলেন দীপঙ্কর।

মৃত দীপঙ্কর বনিকের শোকার্ত মা রমাদেবী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

মৃত দীপঙ্কর বনিকের শোকার্ত মা রমাদেবী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

সংগ্রাম সিংহ রায়
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০২:৩৮
Share: Save:

একটা বেপরোয়া স্কুলবাস ওলটপালট করে দিল বণিক পরিবারের সব কিছু।

শুক্রবার আদালতের অস্থায়ী করণিক পদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল দীপঙ্করের। সকালে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ঠিকাদারের অধীনে আর বিকালে এটিএমে টাকা ভরার সংস্থার রাতদিন খেটে সংসারের ভার বইছিলেন দীপঙ্কর। তাই আদালতের পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কাজে মাথা গোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

পরিবারের লোকজনের কথায়, ভাল প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন দীপঙ্কর। সেই সঙ্গে দূরশিক্ষার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অসমাপ্ত স্নাতক পরীক্ষা শেষ করার চিন্তাভাবনাও মাথায় ছিল। যাতে পরে স্থায়ীকরণের সুবিধা হতে পারে। শুক্রবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছুটিও নিয়েছিলেন কাজ থেকে। আশায় বুক বাঁধছিল গোটা পরিবার। কিন্তু গত বৃহস্পতিবারের বিকালটা সব হিসাব ওলটপালট করে দিল অশোকনগরের বণিক পরিবারের। কাঁদতে কাঁদতে ওই বাড়ির অনেকেই বলছেন, ‘‘বেপরোয়া স্কুলবাস চালানো কি বন্ধ করতে পারবে না পুলিশ-প্রশাসন। মালিকরা কী এতই শক্তিশালী? কেন ভাঙাচোরা বাসে মদ্যপ চালকদের য়াঁরা কাজে নামান, সেই মালিকদের বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয় না জানি না। এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না।’’

তাই দীপঙ্করের স্বপ্নের কথা বলতে বলতে শুক্রবার বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা দুলালবাবু। মা রমাদেবী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই শিলিগুড়ির পুরসভার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বণিক বাড়িতে ভিড় জমাতে থাকেন প্রতিবেশিরা। দীপঙ্করের বাবা, মা, ভাই রূপঙ্কর তো বটেই রাত থেকে মুখে জলও তুলতে পারেননি পাড়ার অনেকেই। সন্ধ্যা থেকেই পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাপস চট্টোপাধ্যায়। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত থেকে শুরু করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনিও সঙ্গে ছিলেন।

এদিন সকাল থেকেই বাড়ির সামনে প্রতিবেশীদের ভিড়। সকলের প্রশ্ন, কখন তাঁদের আদরের দীপুকে শেষবারের মত দেখা যাবে। বিকেলে দেহ আসতেই দেহ আঁকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। পাড়ার দীপুকে একবারের জন্য দেখতে, শেষবারের স্পর্শ করে কান্না ভেজা চোখে বাড়ি ফিরেছেন। সকাল থেকে ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন রমাদেবী।

পাড়াতে সকলের প্রিয় ছিলেন ২৮ বছরের দীপু। কোথাও কালীপুজোয় খিচুড়ি-সবজি রান্না হোক, বা কারও বাড়ির কোনও বিপদ, ঝাঁপিয়ে পড়তেন সবার আগেই, জানালেন তাঁদেরই এক আত্মীয় রত্না ভট্টাচার্য। মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পড়শি কিশোরীরাও। দুটি বাড়ি পরে থাকে কিশোরী অর্পিতা। মাঝে মধ্যেই ডুকরে কেঁদে উঠছে। অর্পিতা বলল, ‘‘রোজ বাড়ি থেকে কাজে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দু’মিনিট গল্প করে যেত। জানালার দিকে আর তাকাতে পারছি না।’’ তার মা ছায়াদেবী বলেন, ‘‘কোনও এক বন্ধু সরকারি চাকরি পাওয়াতে আমার মেয়ের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। বলেছিল একদিন বাড়িতে নিয়ে আসবে। সবার জন্য ভাবত। সেই ছেলেটা আর নেই। এটাই ভাবতে পারছি না।’’ মৃতের খুড়তুতো ভাইয়ের বউ তুহিনা বণিক জানালেন, সমস্ত আত্মীয়, পড়শি সবাইকে এক সুতোয় বাঁধত। আর কেউ এভাবে ভাবতে আসবে না।

ময়নাতদন্ত হয়ে দেহ বাড়িতে আসতে বিকেল হয়ে যা।। তার ফাঁকে দুলালবাবু জানালেন, দুই ছেলে, স্বামী-স্ত্রী ও ছোট ছেলের বউ নিয়ে অভাবের সংসার। নিজে তেমন কিছু করেন না। মাঝে মধ্যে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট বিক্রির যোগাযোগ করিয়ে দু’পয়সা আয় হয়। তাও নিয়মিত না। ছোট ছেলেও ইলেকট্রিকের কাজ করে। তারও কোনও স্থায়িত্ব নেই। নিয়মিত আয় করে পরিবারকে সামলে রাখতে অমানুষিক খাটত দীপু। সকাল থেকে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ঠিকাদারের অধীনে সুপারভাইজারের কাজ। বিকেলে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে রাত পর্যন্ত এটিএমে টাকা ভরার এজেন্সিতে কাজ।

সব মিলিয়ে তাঁর হাজার দশেক আয় থেকেই পরিবার চলত। আরও ভালভাবে সংসার চালানোর চেষ্টা করছিলেন। চাকরির পরীক্ষাও দিচ্ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকের পর বাধ্য হয়ে পড়া ছাড়তে হয়েছিল সংসারের চাপেই। উৎসাহ দিতাম। ও বলেছিল বাবা একটু সময় দাও। কিন্তু একটা বেপরোয়া স্কুল বাস সংসারের স্বপ্ন সব ওলটপালট করে দিল।’’

কথা বলতে বলতে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন দুলালবাবু!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

school bus accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE