আদিবাসী নবজাগরণ সম্মেলনে রোমা এক্কা। — নিজস্ব চিত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার পাঠ শেষ করে কলকাতার ইঁদুরদৌড়ে একা লড়ে নিজের হাতে ভাগ্য তৈরি করছিল মেয়ে। কিন্তু ছবি এবং টেলিভিশন জগতে কেরিয়ার শুরর মাঝপথেই আবার শিকড়ের টানে ফিরে এলেন অবহেলিত, বঞ্চিত নিজের চেনা পরিসরে। সেখানে এখনও শুধু সচেতনতার অভাবে বাঁচার লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকে শ’য়ে শ’য়ে অসহায় মুখ। অথচ এক দিন তাঁদের মাঝখান থেকেই আত্মবিশ্বাসের শক্তিটুকু সঞ্চয় করে নিয়েছিলেন বছর পঁচিশের রোমা। তাই আজকে সেই শক্তির কণা তাঁদেরকেই ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী ফাঁসিদেওয়ার রোমা এক্কা।
গত কয়েক মাস ধরে ফাঁসিদেওয়ার বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে আদিবাসীদের শিক্ষা, কুসংস্কার, নারী পাচার প্রচারের কাজ শুরু করেন বছর তিনি। তাঁর কথায় অনেকে বিশ্বাস করেন। অনেকে আবার দোটানায় ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে নেতামন্ত্রীদের অফিস, বাড়িতে গিয়ে কাজের ইচ্ছার কথা বোঝান। শুধু ফাঁসিদেওয়া নয়, কলকাতায় এমএলএ হস্টেলে গিয়ে উত্তরবঙ্গের কয়েক জন বিধায়কদের সঙ্গে দেখাও করেন। সুশিক্ষার অভাবে সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য পাল্টানো ঠেকাতে একটি সম্মেলন বা শিবিরের পরিকল্পনা নেন। স্থানীয় মেয়ের কথা ভেবে কেউ স্কুলের মাঠের ব্যবস্থা, কেউ বা প্যান্ডেল, কেউবা জেনারেটর দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েও দেন।
রবিবার চটহাট হাইস্কুল মাঠের এমনই শিবিরে রোমা বসিয়ে দিলেন চাঁদের হাট। রাজ্যের আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রী জেমস কুজুর, বিধায়ক সুনীল তিরকে-সহ পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারেরাও শিবিরে যোগ দিলেন। আদিবাসীদের মাদল, করম নাচ, কচিকাঁচাদের মার্চপাস্ট দেখে আবেগে ভাসলেন সকলেই। সরকারের নানা প্রকল্প, সুযোগ সুবিধার কথা যেমন মন্ত্রী জানালেন, তেমনই শুনলেন মাধবী পাহানের মত স্কুল পড়ুয়ার কাছ থেকে রাস্তার সংস্কারের দাবিও। মন্ত্রী বললেন, ‘‘আমার বাবা-মা’ও বাগানে কাজ করতেন। আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। তাই আমি আজ এখানে। আপনারাও ছেলেমেয়েদের আগে পড়ান। রোমার সঙ্গে থাকুন। উন্নয়নের কাজআমরা করব।’’
ঘোষপুকুর লাগোয়া এলাকায় বাড়ি রোমার। বাবা আধা সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। ভাই-বোন, মায়ের সংসারে ইসলামপুর, শিলিগুড়ি হয়ে রোমার পড়াশোনা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘ভরতনাট্যম’-এ স্নাতক। ইতিমধ্যে কলকাতায় কিছু সিনেমা, সিরিয়ালে ছোট রোলে অভিনয়ও করে ফেলেছেন রোমা। এ বার ঠিক করেছেন, নিজের আদি ভিটায় থেকে সমাজের জন্য কাজ করবেন। স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে আদিবাসী নবজাগরণ সমিতির নামে সংগঠন গড়ার কাজও শুরু করেছেন তিনি। বাকি শুধু, রেজিস্ট্রেশন।
রোমা বললেন, ‘‘আমাদের সমাজের যা অবস্থা দেখছি, তাতে আর বসে থাকা যায় না। তাই নিজের কাজের বাইরে এই কাজে নেমেই পড়লাম। দেখাই যাক, কতটা পারি।’’ তিনি জানান, চা বাগান থেকে বস্তি, সর্বত্র আদিবাসীরা বঞ্চিত। ১৩০ টাকা হাজিরা, জমিবাড়ি নেই। কারও সঠিক দিশা নেই। এর প্রধান কারণ পড়াশোনা আর সচেতনতার অভাব। সরকারি হাজার সুযোগ সুবিধা থাকলেও এরা জানতে পারে না।
শুধু প্রচারেই থেমে থাকেননি রোমা। নিজের পরিচিত বিসিএস অফিসার, বালুরঘাটের প্রবীণঅনুপ সোরেনকে দিয়ে এ দিন আদিবাসীদের সুযোগ সুবিধার কথা সবাইকে জানানোর ব্যবস্থাও করেন। তাই হয়তো, সুশীলা মিনজ, কবিতা ওঁরাও, ভানুমতী এক্কার মত মহিলারা শিবিরে এসে বললেন, ‘‘কন্যাশ্রী, সাইকেল, স্টাইপেন্ড, পড়ার স্কুল, হস্টেল, শংসাপত্র, জমির অধিকার, পাট্টা, স্বনির্ভরের প্রশিক্ষণ কত কী জানলাম। রোমার সঙ্গে থাকতে হবে।’’ সকলেই অনুষ্ঠানে ফুল, পাতা দিয়ে রোমাকে সংবর্ধনাও জানালেন। আবার স্থানীয় বিধায়ক সুনীল তিরকে বা মহকুমা পরিষদ সদস্য আইনুক হক জানালেন, ‘‘রোমার মত মেয়েরা এগিয়ে এলে সরকারি প্রকল্পের কাজগুলি আরও তাড়াতাড়ি হবে।’’
ফাঁসিদেওয়া ব্লকের ঘোষপুকুর, বিধাননগর, চটহাট এলাকায় বিভিন্ন চা বাগানে ৪০-৫০ হাজারের মত আদিবাসীদের বসবাস। রোমা জানান, বাগানের কাজ আর নেশা, এই তো জীবন। তার পর বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী পাচার। মেয়েরা বাগান থেকে কাজের খোঁজে বাইরে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা খারাপ সঙ্গে পড়ছে। বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার। তবে প্রথমে শিক্ষা, সচেতনতা বাড়তে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy