রবিবার গোটা কলেজ চত্বর সুনসান! দোতলায় সেমিনার হলের দিকে পা বাড়ালে কানে আসবে হারমোনিয়ামের সুরে সুরে কথা। কখনও কেউ বলছে ‘দই দই ভাল দই’। কারও গলায় ‘বাঁচব মোরা বাঁচব, ভাল ভাবে বাঁচব।’ কখনও ধীর তালে, কখনও দ্রুত লয়ে জিভের আড়ষ্টতা ভাঙার জন্য কেউ বলে চলেছেন—কচটতপ, খছঠথফ...........।
ব্যাপার কী? খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে মালদহের সামসি কলেজে এমন সব বিষয় নিয়েই পুরদস্তুর নাটকের ক্লাস চলছে। মূল পাঠ্যক্রমের সঙ্গেই এখানে পড়ানো হচ্ছে নাটক। শুধু উত্তরবঙ্গ কেন দক্ষিণবঙ্গের কোনও কলেজে এমন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত হয়নি বলে দাবি করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
অ্যাডর্ন কোর্সের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনোজকুমার ভোজ বলেন, “উত্তরবঙ্গে তো বটেই রাজ্যে কোনও কলেজে এ ভাবে নাটক শেখার কোর্স চালু এটাই প্রথম।” তিনি জানান, বিভিন্ন স্কুলগুলিতে যেমন ভোকেশনাল কোর্স পড়ানো হয়, কলেজগুলিতে চালু হওয়া অ্যাডর্ন কোর্সও তেমনই। পাঠ্যবইয়ের বাইরে এই কোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বিভিন্ন কলেজে এই কোর্সে স্পোকেন ইংলিশ, টেলারিং, স্পোকেন সংস্কৃত শেখানোর কোর্স চালু রয়েছে। এখানে চলছে নাটক শেখার ক্লাস।
আর নাটকের ওই ক্লাস হচ্ছে রবিবার ছুটির দিনেই। গত ৩ জানুয়ারি থেকে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু হয়েছে নাটক শেখার ক্লাস। কী ভাবে নাটক লিখতে হয়, অভিনয়, বাচনভঙ্গি, মঞ্চে আলো, ধ্বনির ব্যবহার, নাটকের গান, পোশাক, কোরিওগ্রাফি এক কথায় নাটকের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি শেখানো হচ্ছে হাতে কলমে। শুধু স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাই নয়, নাট্যোৎসাহী যে কোনও ব্যক্তিই ওই কোর্স করার সুযোগ পাবেন। উত্তরবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে তা সুখবর বৈকি।
একটা নাটক কী ভাবে পড়তে হয়? প্রশ্নোত্তর লেখার জন্য নাটক পড়া একরকম, আর নাটক চর্চার মধ্য দিয়ে তা অনুভব করে পড়া অন্যরকম। সংলাপ বলার মধ্য দিয়ে চরিত্রটাকে বোঝার চেষ্টা। যেমন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর পড়ানোর পর শেখানো হচ্ছে মাধব দত্ত নামক চরিত্রটির পোশাক কেমন হওয়া উচিত। তার বয়স কত হতে পারে, তার হাঁটাচলাই বা কী রকম? নাটকের এমন নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে হাতে কলমে শেখানো হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। তাতে উৎসাহ বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। কোর্স তিনটি সেমিস্টারের। প্রতিটি সেমিস্টারের মেয়াদ তিন মাস। শুধু এই কলেজেরই নয় আশেপাশের স্কুল-কলেজ থেকেও উৎসাহী ছাত্রছাত্রীরা ভিড় জমাচ্ছেন। বর্তমানে ২৬ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে রবিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল পাঁচ পর্যন্ত চলছে নাটক শেখার ক্লাস। কলেজের বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবশ্য কোর্স ফি নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
অভিনেতা ও পরিচালক গৌতম হালদার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘‘এটি খুবই ভাল উদ্যোগ। থিয়েটার যেন ঠিক পথে হয়, ভাল ভাবে হয়, গভীর ভাবে হয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘নাটক তৈরি করা খুব পরিশ্রমের কাজ। খুব কঠিন। শরীর, মন, মেধা সব কিছু লাগে। সেই সঙ্গে নিজেকে আরও কিছু যোগও করতে হয়। কিছু ছাত্রছাত্রীও যদি এর ফলে থিয়েটারে আসে, তা হলে বাংলা থিয়েটার উপকৃত হবে।’’
নাটকের ঘরের কথা হাতেকলমে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে নাট্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা কলকাতা থেকে এসে ক্লাসও নিচ্ছেন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিস্থিতি বা পরিবেশ অনুযায়ী নাটকে গান বা আবহসঙ্গীতের ব্যবহার কী করে করতে হয়। কেউ শেখাচ্ছেন অভিনয়ের নানা কলা। আবার কেউ শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে দিচ্ছেন, একটা গল্প থেকে কী করে নাটক রচনা করতে হয়। বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী পূজা চৌধুরী জানান, নাটক ভাল লাগে। কিন্তু নাটক মঞ্চস্থ করতে হয় কী ভাবে বা নাটকের মধ্য এত কিছু জানার বিষয় রয়েছে, তা আগে তাঁর জানা ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘আমার মতো যাঁরা নাটক ভালবাসেন বা নাট্যপ্রেমী তারা এই ধরনের কোর্স করতে উৎসাহী হবেন।’’ হাতে কলমে নাট্যচর্চার পাশাপাশি পড়ানো হচ্ছে বাংলার নাট্যশালার ইতিহাস, গ্রিক নাট্যকলা বা ভারতের নাট্যশাস্ত্র।
কিন্তু কেন নাটক পড়ানো হচ্ছে? কেরিয়ার গড়তেই বা এই নাটক প্রশিক্ষণ কী কাজে আসবে?
কলেজ কর্ত্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, বিষয় হিসাবে নাটক যদিও পাঠ্য তালিকাভুক্ত রয়েছে কিন্তু তাতে ছাত্রছাত্রীরা নামকরণের সার্থকতা, চরিত্র বিশ্লেষণের মতো পড়াশোনার মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন। শুধু বাংলায় নয় ইংরেজি, সংস্কৃত বা আরবি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা নাটক সম্পর্কে এরকমই বোঝেন। কিন্তু অ্যাডর্ন কোর্স-এ নাটক শেখা তার ব্যতিক্রম। এই কোর্সে নাটক শেখার ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের জানানো হয়েছে, এই প্রশিক্ষণ হয়তো কেরিয়ার গড়তে সে ভাবে কাজে লাগবে না কিন্তু শুধু নাট্যোৎসাহীদের কাছে এই কোর্স অবশ্যই আকর্ষণীয়। কোর্স কো অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনোজ কুমার ভোজের মতে সকলে মিলে নাটক মঞ্চস্থ হয়। তাই নাটকের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ এবং সংবেদনশীল হওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে। কলেজের অধ্যক্ষ প্রলয়কান্তি ঘোষ জানান, কোর্সে একই ধরনের জিনিস না শিখিয়ে অন্য বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহী করতে নাট্যশিক্ষা চালু করা হয়েছে। কোর্স শেষে তাঁদের হাতে শংসাপত্রও তুলে দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy