Advertisement
১১ মে ২০২৪

লটারির টিকিট বিক্রিতে কড়া নজর

কেউ দিনভর রিকশা চালিয়ে দিনান্তে যা উপার্জন করেন, তার পুরোটাই লটারির টিকিট কেনায় খরচ করে ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কেউ ব্যবসার কেনাবেচার টাকা তো বটেই, মূলধনের টাকাও লটারির টিকিট কেনায় বিনিয়োগ করে দিচ্ছেন।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৩৯
Share: Save:

কেউ দিনভর রিকশা চালিয়ে দিনান্তে যা উপার্জন করেন, তার পুরোটাই লটারির টিকিট কেনায় খরচ করে ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কেউ ব্যবসার কেনাবেচার টাকা তো বটেই, মূলধনের টাকাও লটারির টিকিট কেনায় বিনিয়োগ করে দিচ্ছেন। আবার কেউ উদয়াস্ত ফুটপাতে চা দোকান চালিয়ে যা আয় করেন, তার সিংহভাগই রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় লটারিতে ঢেলে দিচ্ছেন। তাতেই ধারদেনায় ডুবে ক্রমশ বিপদের মুখে পড়ছেন অনেকে। মঙ্গলবার শিলিগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর চিরঞ্জীব দাসের মৃত্যুর পরে এই নিয়েই জোর আলোচনা শাসকদল ও প্রশাসনের মধ্যে। খোদ জেলা সভাপতি গৌতম দেব থেকে পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের অনেকেই এই নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, ‘‘চিরঞ্জীবের মৃত্যু আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। ওঁর মৃত্যুর পরে লটারি সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ শুনেছি। আমাদের তরফে যা করণীয় সেটা করব।’’

পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের অনেকের মতে, যে সব লটারির ব্যবসা বৈধ, তা নিয়ে কারও কিছু বলার নেই। তবে, নিজের ও পরিবারের হিতাহিত ভুলে যাতে কেউ লটারির টিকিট কিনে হুট করে ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর না হন, সেই ব্যাপারে বাসিন্দাদের সচেতন করা দরকার বলে মনে করছেন অফিসারেরা। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের একাধিক অফিসার জানান, যে ভাবে পাড়ায়-পাড়ায় টেবিল নিয়ে লটারির স্টল গজিয়ে উঠছে তা দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ, কোন লটারির টিকিট আসল, আর কোনটা নকল— তা সব জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা করার মতো পরিকাঠামো পুলিশ-প্রশাসনের নেই বলে একান্তে জানিয়েছেন একাধিক শীর্ষ কর্তা। শুধু তাই নয়, কয়েকটি ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বিশাল অঙ্কের লটারি পেয়েছেন বলেও মিথ্যে রটানো হয়ে থাকে বলে শিলিগুড়ি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সন্দেহ। গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার জানান, কখনও এক রিকশাচালক, আবার কোথাও একজন ভিখারি বিপুল অঙ্কের লটারি পেয়েছেন বলে রটিয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানোর ছক কষা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে। এমনকী, পুলিশের নিচুতলার কয়েক জন কর্মীও লটারিতে আসক্ত হয়ে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রটি জানিয়েছে।

রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল তো বটেই, বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিরাও একান্তে মানছেন, দলীয় পর্যায়ে তাঁদের নিচুতলার নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যেও যথেচ্ছ লটারি টিকিট কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শিলিগুড়ি কলেজ, কোর্ট মোড়, হাকিমপাড়ার মহকুমা পরিষদ লাগোয়া এলাকা কিংবা বিধান রোড, সেবক রোড, হিলকার্ট রোডে ছড়িয়ে রয়েছে অন্তত ৪০০ লটারি বিক্রেতার টেবিল। তৃণমূলের জেলা যুব সভাপতি বিকাশ সরকার বলেন, ‘‘কোনও কিছুর নেশাই ভাল নয়। লটারির নেশা ধরে গেলেও হিতে বিপরীত হতে পারে।’’

লটারি বিক্রেতাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে শিলিগুড়িতে ভিন রাজ্যের লটারির চাহিদা তুঙ্গে। সারা দিনে ৩ বার লটারি হয়। ১০ টাকা দামের টিকিট। একযোগে ৫টি কাটতেই হবে। তা হলে মিলতে পারে বিপুল অঙ্কের পুরস্কার। সেই আশায় শয়ে-শয়ে লোক টিকিট কাটছেন। হাকিমপাড়ার একটি লটারির দোকানে গেলে বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জন জানান, ক’দিন আগেই নাকি এক ভিখারি বহু লক্ষ টাকা পেয়েছেন। লটারি বিক্রেতা জানান, তার আগে এক ভ্যান চালক বহু লক্ষ টাকা পেয়েছেন। কিন্তু, দুজনের নাম-ঠিকানা চাইলে কেউ দিতে পারেননি। বলা হয়, ভ্যানচালক আশিঘরে থাকেন। কিন্তু সেখানেও এমন কারও খোঁজ মেলেনি।

ভিখারির বাসস্থান জানতে চাইলে একবার বলা হয় হলদিবাড়িতে থাকেন। বিশদ ঠিকানা জানতে চাইলে বলা হয়, মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা, সেখানে চলে গিয়েছেন। এমন রটনার জেরেই চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী, দিনমজুর থেকে ভ্যানচালকদের ভিড় উপচে পড়ে রোজই নানা লটারির দোকানে, স্টলে। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের কাউন্সিলর আত্মঘাতী হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও এলাকার এক লটারি বিক্রেতা ভারত দামের কাছে গিয়ে রাত ৮টার খেলার নির্দিষ্ট সিরিজের টিকিটের খোঁজ করেছিলেন। ভারতবাবু বলেন, ‘‘চিরঞ্জীবদা মাঝেমধ্যেই আসতেন। সোমবার যখন বললাম, ওই টিকিট নেই, তখন পাশের দোকানে চা খেয়ে চলে গেলেন। সেটাই যে শেষ দেখা, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lottery Tickets Checking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE