E-Paper

ওদের জন্য রোজ খোলা তিস্তাপারের পাঠশালা

সম্প্রতি নানা কারণে মন্দিরের চাতালে পাঠশালা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, তা হলে কি বন্ধ হয়ে যাবে পাঠশালা? এগিয়ে এলেন কয়েক জন বাসিন্দা।

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৬:১১
জলপাইগুড়ির তিস্তা পাড়ের বিদ্যামন্দিরে চলছে পড়াশোনা।

জলপাইগুড়ির তিস্তা পাড়ের বিদ্যামন্দিরে চলছে পড়াশোনা। ছবি: সন্দীপ পাল।

নদী-বাঁধের পাশে চরের একফালি জমিতে ফলত লাউ, কুমড়ো, পালং শাক। সে সব গাছ সরিয়ে ফেলে জমিতে গড়ে উঠেছে পাঠশালা। তিস্তাপারের পাঠশালা। বিনামূল্যে পড়া এবং আরও কিছু শেখার আস্তানা।

করোনার আবহে যখন স্কুল বন্ধ ছিল, সে সময়টায় জলপাইগুড়ির তিস্তাপারের রক্ষাকালী মন্দিরের চাতালে চরের বাসিন্দা দিনমজুর, টোটোচালক, অন্যের বাড়িতে কর্মরত পরিচারিকা এবং চাষির পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ডেকে এনে পড়াশোনা করিয়েছেন কয়েক জন শিক্ষক। সে পরিস্থিতি পেরিয়ে এখনও সেই মন্দিরের চাতালে চলেছে অবৈতনিক এই পাঠশালা। সম্প্রতি নানা কারণে মন্দিরের চাতালে পাঠশালা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, তা হলে কি বন্ধ হয়ে যাবে পাঠশালা? এগিয়ে এলেন কয়েক জন বাসিন্দা। সকলেরই তিস্তা চরে বসবাস। চরে বাঁধের পাশের জমির সরকারি কাগজপত্র নেই। চরের জমি ‘দখল’ করেই চলে বসবাস, চাষবাস। সেই জমির ভাগ পেল পাঠশালাও। বাড়ির সামনের এক ফালি জমি থেকে বাগান সরিয়ে শিবানী দাস জায়গা দিয়েছেন স্কুলকে। সেখানেই চলছে ষাট জন পড়ুয়ার পড়াশোনা।

প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ারা আসে এই পাঠশালা। এক দিকে বাঁধ, অন্য দিকে তিস্তা, নদীর ধূ ধূ শুকনো খাত। চর জুড়ে চলছে চাষ-আবাদ। সেখানেই গজিয়ে উঠেছে একটি পাঠশালা। পাঠশালার পনেরো জন শিক্ষকের কেউ শহরের স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কেউ গবেষক, কেউ সদ্য কলেজ-পাশ তরুণী। নিজেদের সাধ্যমতো চাঁদা তুলে স্কুলের খরচ চালান। জলপাইগুড়ির অরবিন্দ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্ষৌণীশ গুহ বলেন, “খরচ আর তেমন কী! বোর্ড, চক ডাস্টার। পড়ুয়াদের খাতা। আমরাই সে সব ব্যবস্থা করি। অনেকে আবার বাঁধের রাস্তা দিয়ে চলার পথে এমন একটি খোলা চত্বরে পাঠশালার মতো স্কুল দেখে পড়ুয়াদের উপহারও দিয়ে যান।”

পাঠশালা বলতে চরের জমিতে কয়েকটি বাঁশের খুঁটি, তার ওপরে টিনের চালের ছাউনি। তিন দিকে অর্ধেক টিনের দেওয়াল। বাঁশ-টিন কিনতে কিছু খরচ লেগেছে, সেগুলি জোগাড় করে দিয়েছেন পাঠশালার শিক্ষকেরাই। চাল ছাইতে, দেওয়াল তুলেছেন পাঠশালার পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরাই। অভিভাবক তপন দাসের বক্তব্য, ‘‘টোটো চালিয়ে সংসার চলে। বাচ্চাকে কোথাও পড়তে পাঠাব, সে ক্ষমতা নেই। এই পাঠশালায় পড়া, ছবি আঁকা— সবই শিখছে আমার ছেলেমেয়ে।’’

বিভিন্ন ক্লাসের পড়ুয়ারা এলেও এই পাঠশালায় পড়ুয়াদের ভাগ করা হয় কে, কোন বিষয়ে দুর্বল সে ভাবে। সেই বিষয়গুলিতেই জোর দেওয়া হয় পড়ুয়াকে। দাদা-দিদিদের সঙ্গে একেবারে খুদে পড়ুয়ারাও আসে। তবে খুদেদের পড়ানোর ভার পড়ে পাঠশালারই বড় পড়ুয়াদের উপরে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অনন্যা, দোয়েল, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আবিরদের উপরে ভার রয়েছে একেবারে খুদে, অর্থাৎ, প্রথম শ্রেণির নীচের পড়ুয়াদের পড়ানোর। দোয়েল বলে, “আমি এখানে নিজেও পড়ি, ছোটদেরও পড়াই। আমাদের পাঠশালা বন্ধ থাকে না কোনও দিন।”

পড়ুয়ারা সকলেই কোনও না কোনও স্কুলে পড়ে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পাঠশালা চলে। তার পরে পড়ুয়ারা বাড়ি ফিরে চলে যায় স্কুলে। শনিবার পাঠশালায় গিয়ে দেখা গেল, আঁকার ক্লাস চলছে। কলেজ-পাশ প্রেরণা সেন আঁকা শেখাচ্ছিলেন। প্রেরণা বলেন, “এদের জন্য একাধিক শিক্ষক রাখা সম্ভব নয়। তাই অভিভাবকেরা পাঠশালায় পাঠান। পড়ার ফাঁকে গান-কবিতা হয়। কোনও দিন পাঠশালা বন্ধ রাখার কথা বললে, পড়ুয়ারাই রাজি হয় না।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

school COVID-19 Teesta River

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy