Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বাজির ভোজ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে

ফল বেরোনোর আগে হাওয়া গরম হচ্ছিল তরজায়। তবে শুধু তরজায় কি আর মন ভরে? তাই বাজিতেই তৃপ্তির খোঁজ করছিল তুফানগঞ্জ থেকে তপন— উত্তরবঙ্গের আম বাসিন্দারা।

অঙ্কণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অঙ্কণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০২:৩৬
Share: Save:

ফল বেরোনোর আগে হাওয়া গরম হচ্ছিল তরজায়। তবে শুধু তরজায় কি আর মন ভরে? তাই বাজিতেই তৃপ্তির খোঁজ করছিল তুফানগঞ্জ থেকে তপন— উত্তরবঙ্গের আম বাসিন্দারা। কেউ বাজিতে চড়িয়েছেন গাছের আম কেউ বা মেয়ের পাওয়া ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল। কারও আবার কলজের জোর বেশি! তিনি তাই দর হেঁকেছেন জোড়া পাঁঠা নিয়ে। ফল বেরোনোর পরে সেই হিসেব ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে’ বুঝে নেওয়ার পালা। সেই দৃশ্যই এখন দেখা যাচ্ছে উত্তরের মোড়ে মোড়ে। কেউ তেমাথা মোড়ে খিচুড়ি বিলোচ্ছেন। বাজি জেতার টাকায় কোথাও পাত পেড়ে ডিমের ঝোল দিয়ে ভোজ হচ্ছে। কোথাও আবার টাকা জমা পড়েছে সর্বজনীন পুজোর তহবিলে। অলিগলির এমন নানা দৃশ্যের ভিড়েই উঁকি দিল আনন্দবাজার।

উঠোনে জোড়া পাঁঠা

শুক্রবার বিকেলে থেকে নধর দু’টি পাঠা পরিমল দাসের বাড়ির নতুন অতিথি। দিনভর উঠোনে বেঁধে রাখছেন দু’টিকে। রাতের বেলায় দাওয়ায় বস্তা বিছিয়ে তিনি পাঁঠা দু’টিকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। দেদার কাঁঠাল পাতাও খাচ্ছে তারা। তবে এ ধরাধামে আর বেশিদিন নেই তারা। আজ, রবিবার পাড়ায় ভোজের আয়োজন রয়েছে। জলপাইগুড়িতে কংগ্রেস প্রার্থী জিতবে বলে বাজি ধরেছিলেন নির্মাণ কর্মী পরিমলবাবু। এলাকার এক তৃণমূল নেতা, যিনি আবার শাসক দলের অঞ্চল কমিটির সভাপতিও, তার সঙ্গেই বাজি ধরেছিলেন পরিমলবাবু। তৃণমূল নেতাই বাজির ‘রফা’ ঠিক করে দিয়েছিলেন। জোড়া পাঁঠা। চায়ের দোকানে বসে কাগজে লেখাও হয়েছিল বাজির শর্ত। দু’পক্ষ ছাড়াও চায়ের দোকানে আড্ডায় জড়ো হওয়া পাড়ার বাসিন্দারাও সাক্ষী হিসেবে সইও করেছিলেন। কথা ছিল, ভোট গণনার পরেই রফা চুকিয়ে দেওয়া হবে। যদিও, জলপাইগুড়ি আসন হাতছাড়া হওয়ায় মনমরা হয়ে পড়া ওই তৃণমূল নেতা গত বৃহস্পতিবার দুপুরেল পর আর বাড়ি থেকে বের হননি। পরদিন বিকেলে পরিমলবাবুকে হাটে ডেকে নিয়ে জোড়া পাঁঠা ধরিয়ে দিয়েছেন। পরিমলবাবু জানালেন, সেই পাঁঠার মাংস দিয়ে ভোজ হবে এমনই লেখা রয়েছে চুক্তিপত্রে। সেই মতো আজ, রবিবার বিকেল থেকে মাংস-ভাতের ভোজ হবে। সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন তৃণমূল কর্মীরাও। পরিমলবাবু বললেন, ‘‘যে বাজি হেরেছেন তিনিও থাকবেন। এটাই আমাদের গ্রামের দস্তুর। প্রতিবার ভোটেই এমন কত বাজি হয়! এ বারও সেটাই হচ্ছে।’’ তবে এ বার একটু সমস্যাতেও পড়েছেন পরিমলবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘জোড়া পাঁঠা দেখতে সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে এসে কেউ না কেউ খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। আর কাঁঠাল পাতা ছাড়া কিছু মুখেই তুলতে চাইছে না ওরা দু’টি। বলুন তো, এত কাঁঠাল পাতা পাই কোথায়?’’

তেরো হাঁড়ি রসগোল্লা

খুব বেশি হলে দশ হাঁড়ি রসগোল্লাতেই কুলিয়ে যাবে ভেবেছিলেন কোচবিহারের দেওয়ানহাটের এক ঠিকাদার। গ্রাম পঞ্চায়েতের নানা নির্মাণ কাজ করেন তিনি। নাটাবাড়ি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী জিতবেন বলে বাজিও ধরেছিলেন তিনি। লাগোয়া লাগোয়া হাড়িভাঙা অঞ্চলে তৃণমূল প্রার্থী লিড পাবে বলেও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তার ঘোষণা মানতে পারেননি এলাকার বাসিন্দাদের কয়েকজন। প্রত্যয়ী ওই ঠিকাদার দাবি করেছিলেন, আলবাত তাঁর কথা ফলবে। কথা ফলে গেলে পাড়ার মোড়ে রসগোল্লা খাওয়াবেন বলেও দাবি করেছিলেন। ওই ঠিকাদারের ঘোষণা মোবাইলে রেকর্ডও করে রেখেছিলেন এক ফরওয়ার্ড ব্লক সমর্থক। ব্যস আর যায় কোথায়! ফল ঘোষণা হতেই রসগোল্লার আবদার শুরু। কথা ফলে যেতেই শনিবার সকালে রসগোল্লার আটটি হাঁড়ি নিয়ে পাড়ার মোড়ে এসেছেন তিনি। তবে রসগোল্লা বিলি হচ্ছে শুনে জড়ো হয়ে যায় অনেকেই। হিসেব বাড়তে থাকে ‘চড়াম চড়াম’ করে। দুপুরে বেজার মুখে ঠিকাদার বললেন, ‘‘পরে আরও মিষ্টির হাঁড়ি আনতে হয়েছে। হিসেব করে দেখেছি তেরো হাঁড়ি মিষ্টি খাওয়ানো হয়েছে।’’ রসে ভেজা ফাঁকা হাঁড়ি এখন রয়ে গিয়েছে এলাকার চায়ের দোকানের একপাশে।

হাতে গরম লাখ টাকা

দেনেওয়ালা যবভি দেতা দেতা ছপ্পর ফাড়কে! সিতাইয়ের গল্পটা তেমনই। কোচবিহারের সিতাই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীর উপরে লক্ষ টাকা বাজি ধরেছিলেন তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা। লোকসভা ভোটের অঙ্কের হিসেবে ওই কেন্দ্রে জোট প্রার্থীর খুঁটি শক্ত ছিল। তাই আত্মবিশ্বাসী হয়েই এত টাকার দর হেঁকেছিলেন। কথা ছিল, জিতলে লক্ষ টাকা ওই নেতা পাবেন। হারলে ওই টাকা আরেকজনকে দিয়ে দিতে হবে। ওই কেন্দ্রেও জয়ী হয় তৃণমূল। এর পরেই টাকা জিতে যান তিনি। তিনি বলেন, “সন্দেহ আমারও ছিল। মনের জোরে বাজি ধরেছি। জিতেও গেলাম।” কোচবিহার দক্ষিণ কেন্দ্রের প্রার্থী মিহির গোস্বামীর উপরেও বাজি ধরেছিলেন ঘুঘুমারি এক বাসিন্দা। ওই বাজি ছিল দু’হাজার টাকার সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকার। আগাম এক ব্যক্তির কাছ থেকে দু’হাজার টাকা জমাও নেন তিনি। হারলে কুড়ি হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। তিনি বলেন, “ঝুঁকি নিয়েছিলাম। হাওয়া যা ছিল তাতে জোট জিতবে বলেই প্রচার বেশি ছিল। কিন্তু তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী ছিল। তাই সেদিকেই বাজি ধরেছি।”

মেয়ের সাইকেল

গত জানুয়ারি মাসেই সবুজ সাথীর সাইকেল পেয়েছিল নবম শ্রেণির ছাত্রীটি। তবে ভোটের ফল নিয়ে তার কোনও আগ্রহ ছিল না। ছাত্রীর বাবা কিন্তু মালবাজারের পরিচিত তৃণমূল নেতা। ভোটের হাওয়ায় তিনি সকলের মতোই মেতে উঠেছিলেন তরজায়। ভোটের ঢের আগে পার্টি অফিসে বসে আলোচনায় দাবি করেছিলেন যে ভাবেই হোক মালবাজার কেন্দ্রে দলের প্রার্থী অন্তত ১০ হাজার ভোটে জিতবে। তাঁর কথা মানতে পারেননি দলের নেতারাই। উত্তেজিত হয়ে সে সময়েই তিনি বাজি ধরার ঘোষণা করেন। স্কুল থেকে পাওয়া মেয়ের সাইকেলই বাজি ফেলেন তিনি। তখন বুক বাজিয়ে ও কথা বলে ফেললেও পরে অবশ্য আফশোস করেছিলেন একান্তে। যদি ফল উল্টো হয় মেয়ের সাইকেল দিয়ে দিতে হবে। মেয়ে যদি আবার গোঁসা করে! তাই বেশ টেনশনেও ছিলেন। তবে মালবাজার কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতে যাওয়ায়, সাইকেল দিতে হয়নি। ফল বেরোনোর পরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ওই নেতা। এ দিন লাজুক মুখে বললেন, ‘‘উত্তেজিত হয়ে যাওয়ায় তখন আমি সাইকেলই বাজি ফেলি। পরে অবশ্য খুব আফশোস হয়েছিল। কিন্তু যাই হোক সাইকেলটা দিতে হয়নি।’’

সন্দেশে জোড়াফুল

রাজ্যে শাসক দলের জয়জয়কারে ফালাকাটায় দেদার বিকোচ্ছে তৃণমূলের প্রতীক চিহ্ন জোড়াফুলের আকারে তৈরি সন্দেশ। জোড়াফুল চিহ্নের সন্দেশ বিক্রি হচ্ছে এই খবর চাউর হতেই ভিড় জমে যায়। ফালাকাটার নেতাজি রোডের মিষ্টি ব্যবসায়ী উজ্বল কর জোড়া ফুলের সন্দেশ তৈরির কারিগর। ভোট গণনার আগে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি দাবি করেছিলেন তৃণমূল ভোটে জিতলে প্রতীক চিহ্নের আদলে সন্দেশ বানাবেন। শাসকদল দু’শোর গণ্ডি পার হওয়ার পরেই তিনি সন্দেশ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। গত শুক্রবার সন্দেশ তৈরি করা হয়। কিন্তু ওই দিন কয়েকটি বিক্রি হলেও জোড়াফুল সন্দেশ মিলছে এই খবর ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা সময় লাগে। এ দিন শনিবার থেকে ভিড় উপচে পড়ে দোকানে। উজ্জ্বলবাবু বলেন, “ছোট সন্দেশের দাম ১০ টাকা এবং মাঝারি সন্দেশের দাম রেখেছি ১৫ টাকা। ভালই বিক্রি হচ্ছে। বেশ কিছুদিন চালিয়ে যাব ভাবছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE