Advertisement
০১ মে ২০২৪

জংলি শাক, ভাত খেয়ে দিন গুজরান

হাহাকার চলছেই ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের নাগেশ্বরী চা বাগানে। গত চার দিনে তিন জনের মৃত্যুর পরে নতুন করে শ্রমিক পরিবারগুলিতে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে অনটনে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে শ্রমিক পরিবারগুলোকে। যেখানে ভাতের ফেন আর জংলি শাক খেয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে শ্রমিকদের।

নিজেদের অবস্থার কথা জানাচ্ছেন চা বাগানের বাসিন্দারা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

নিজেদের অবস্থার কথা জানাচ্ছেন চা বাগানের বাসিন্দারা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

সব্যসাচী ঘোষ
মেটেলি শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৫ ০২:৪৮
Share: Save:

হাহাকার চলছেই ডুয়ার্সের মেটেলি ব্লকের নাগেশ্বরী চা বাগানে। গত চার দিনে তিন জনের মৃত্যুর পরে নতুন করে শ্রমিক পরিবারগুলিতে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে অনটনে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে শ্রমিক পরিবারগুলোকে। যেখানে ভাতের ফেন আর জংলি শাক খেয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে শ্রমিকদের। সেখানে প্রশাসনিক কর্তা কিংবা কোনও দলেরই নেতারা এখনও বাগানে যাননি বলে অভিযোগ। বাগান কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে গত মার্চের অর্ধেক কর্মদিবসের শ্রমিক মজুরি দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সেই সামান্য টাকায় কতটা কী হবে, তাতেও সংশয়ে শ্রমিকেরা।

গত ৯ মে থেকে বাগানে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। এদের মধ্যে রয়েছে অন্তঃসত্ত্বা রিমা থাপা (১৯) নামের এক মহিলাও। এ ছাড়াও মৃত্যু হয়েছে রাজেশ খেরিয়ার (৪৫) এবং আলিমা ওঁরাও নামের সাড়ে পাঁচ বছরের এক শিশুকন্যাও। রিমার বাড়ি নাগেশ্বরী চা বাগানের গোপাল লাইনের পাহাড়ি ঝোরার পাশে।

ভাঙা কুঁড়েঘরে বসবাস করেন রিমার মা হিরা মাহালি ভাত আর ফেন খেয়েই বৃহস্পতিবারের দুপুরে আহার সেরেছেন। হিরা বলেন, ‘‘মেয়ের মুখটাই বারবার যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দুপুরের খাবার মিটলেই রাতে কী খাব, সেটাও খুব বড় দুশ্চিন্তায় ফেলছে আমাদের।’’ একই অবস্থা বাগানের বছর সাঁইত্রিশের সংযোগ মৃধারও। বাগানের স্থায়ী শ্রমিক সংযোগ গত দুই সপ্তাহ ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সর্বাঙ্গে অসহ্য ব্যথা আর জ্বর নিয়ে সংযোগ বললেন, ‘‘বাগানে কাজ করে বেশ ভালই দিন কাটছিল। তখন ভাবতেও পারতাম না যে এরকম দিন দেখতে হবে। ডাল, ভাত ছাড়া বৃহস্পতিবার দুপুরে কিছুই জোটেনি।’’

বছর পঞ্চান্নর বাগানের মহিলা শ্রমিক বুলি চিক বড়াইক গত এক বছর ধরেই গুরুতর অসুস্থ। কাজ থেকে অসুস্থতা জনিত অবসর নিয়েছেন। মেয়ে কৌশল্যাকে নিজের জায়গায় কাজে ঢুকিয়েছিলেন তিনি। এখন বাগানের অচলাবস্থার জেরে কৌশল্যার মজুরি বন্ধ। চিকিৎসাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে অস্থিচর্ম সার বুলি চিকবরাইকের। কৌশল্যার কথায়, ‘‘মাকে নিয়ে যে শিলিগুড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করাব, এখন সেই সঙ্গতিও নেই আমাদের।’’

একই রকম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন গনশু লোহার, জোসিয়ার লোহারদের মতো নাগেশ্বরী বাগানের ১২০০ জন স্থায়ী শ্রমিকই। বৃহস্পতিবার থেকে প্রশাসনিক উদ্যোগে স্বাস্থ্য শিবির শুরু হয়েছে বাগানে। প্রথম দিনেই শতাধিক রোগী শিবিরে দেখিয়ে গিয়েছেন। তবে ওষুধ মিলছে না বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। শ্রমিকদের ক্ষোভ, খাবার কেনার পয়সাই যেখানে নেই সেখানে ওষুধ তাঁরা কিনবেন কী ভাবে?

পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন বাগানের অনেক যুবক যুবতীই। কাছের চা বাগানগুলোতেও অস্থায়ী কাজ করতে চলে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা। নাগেশ্বরী চা বাগানের কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্যা সবিতা কালিন্দীও অস্থায়ী ভাবে বাইরের বাগানে কাজ করছেন।

নাগেশ্বরী বাগানের পাশের বাগানেই থাকেন নাগরাকাটার কংগ্রেস বিধায়ক জোসেফ মুন্ডা। তিনি বলেন, ‘‘আমি রোজই নাগেশ্বরী চা বাগানে যাচ্ছি। শাসক দলের নেতা কিংবা প্রশাসনিক আধিকারিকদের তো দেখা পাচ্ছি না।’’ তবে তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী পুরো বিষয়টিই মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে বলে জানালেন। তাঁর কথায়, ‘‘আজ শুক্রবার জলপাইগুড়িতে আসছেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁকেও পুরো বিষয়টি বিশদে জানানো হবে।’’ নাগেশ্বরী জাতীয় পর্যায়ের যে বেসরকারি গোষ্ঠীর অন্তর্গত সেই গোষ্ঠীর উত্তরবঙ্গে থাকা ১৬টি চা বাগানেই গত ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকেই অচলাবস্থা শুরু হয়ে যায়। মার্চের পর থেকে মজুরিও বকেয়া বাগানে। নাগেশ্বরীর ম্যানেজার শিলাদিত্য বসুর কথায়, ‘‘বাগানে ১২০০ শ্রমিকদের মার্চ মাসের অর্ধেক দিনের মজুরি মিটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চলতি মাসেই ফের রেশনও দেওয়া হবে।’’

আজ শুক্রবার থেকেই বাগানে একশো দিনের কাজের প্রকল্পও শুরু করা হবে বলে জানান মালবাজারের মহকুমাশাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE