অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নৃত্যনাট্য ও নাটক। নিজস্ব চিত্র।
সুখে, দুঃখে, বিপদে, সম্পদে বাঙালির চির আশ্রয় রবীন্দ্র-গানও রয়েছে অনুবাদের তালিকায়। উত্তরের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাঁদের কথ্য ভাষায় পেলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বোড়ো ভাষার অনুবাদক সুবর্ণা বসুমাতার অভিজ্ঞতা, ‘‘অনুবাদ করার সময় দেখা গেছে মূল গানের যথার্থ বোড়ো শব্দটি বেশ দীর্ঘ। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে সেই শব্দটি চয়ন করা গেলেও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সুর, তাল, ছন্দ মেলানো কঠিন, তাই ভাবানুবাদ করতে হয়েছে।’’
প্রবন্ধের ক্ষেত্রে ‘প্রাচীন সাহিত্য’ থেকে প্রবন্ধ অনূদিত হয়েছে নেপালি ভাষায়, অনুবাদ দিলীরাম তিমসিনহা। উল্লেখ্য, শুধু আঞ্চলিক ভাষার লেখকরাই নন—সনৎ চট্টোপাধ্যায়, ব্যোমকেশ ঘোষের মতো লেখকরাও কলম ধরেছেন রবীন্দ্ররচনা অনুবাদের ক্ষেত্রে। আসলে বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত নন, সেই সব পাঠক যখন গীতাঞ্জলি, মুক্তধারা, বিসর্জন, ক্ষুধিত পাষাণ, সোনার তরী পড়েন, তার বেশ কিছুটা কৃতিত্ব তো অনুবাদকের প্রাপ্য হয়ই। সকলে রবীন্দ্রসাহিত্যের দীক্ষিত পাঠক নন, রবীন্দ্র-গবেষকও নন। বরং সাধারণ পাঠকও রয়েছেন। তাঁদের সহজে পড়ে বোঝা এবং আনন্দ পাওয়ার উৎস এই সাহিত্য-অনুবাদগুলি। ভাষার কারণে এত দিন যা ছিল তাঁদের নাগালের বাইরে, বিশ্বসাহিত্যের সেই সব অনন্য সৃজনকর্ম অনুবাদের ফলে অবশেষে প্রসারিত হল রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক এই অনুবাদের জগতে। ভারততীর্থের সেই ‘দিবে আর নিবে’র উদাহরণের মতোই প্রান্তিক ভাষায় এই রবীন্দ্র-সংলগ্নতাও সে জন্যই এক বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে।
এই অনুবাদকর্ম শুধু মলাটবন্দিই হয়নি, আঞ্চলিক ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাটক, নানা ভাষায় গীত হয়েছে রবীন্দ্রগান। ১৯৬৯-এ নিমতিঝোরা চা-বাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শান্তি দেবীর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় সাদরিতে চণ্ডালিকা। মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস পরিচালিত সাদরিতে চিত্রাঙ্গদার মঞ্চায়ন হয় কলকাতার শিশির মঞ্চে। উত্তরের চা-বলয়গুলিতে মণিদীপার নির্দেশনায় অভিনীত হয়েছে সাদরিতে অনূদিত চণ্ডালিকা।
সাদরি ভাষায় রবীন্দ্রগান নিজের কণ্ঠে পেশ করেছেন রবীন্দ্র ভারতী এবং দিল্লির দর্শকদের দরবারে। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রাজবংশী ভাষায় রবীন্দ্রগীতি আলেখ্য সম্প্রচারিত হয় স্থানীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে ইন্দিরা রায় নার্জিনারী পরিবেশন করেছেন বোড়ো ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বোড়োদের নিজস্ব পোশাক ‘ডোকনা’ পরে রবীন্দ্রনৃত্যে অংশ নেন জলপাইগুড়ি তারাপ্রসাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। আমরা যদি এই ভাবে আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি, তবে একদিন দেখব আমরা বঙ্গ দেশের বহু গভীরতর প্রান্ত দেশে পৌঁছলেও তার ভাষার অনেকটাই যেন আমাদের অপরিচিত নয়। আর যেখানে অন্য প্রান্তের ভাষা আমার পরিচিত, সেখানেই আমি সেই প্রান্তের কাছের মানুষ। বলতে পারি সহজেই—আমি তোমাদেরই লোক।
ভাষা গবেষক সুবোধকুমার যশ, দীপককুমার রায় এবং কৃষ্ণরাজ ঘাটানি জানালেন, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক অনুবাদগুলির মধ্যে দিয়ে দুটি সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটছে। পাশাপাশি ছোট ছোট ভাষাগুলি বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস তৈরি হচ্ছে। যেমন সাদরি, বোড়ো, ধীমাল, রাজবংশী ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে সেই ভাষাগুলির ভাষিক বৈশিষ্ট্য যেমন উঠে আসছে, তেমনই যে ভাষা থেকে অনুবাদ হচ্ছে সেই ভাষা ও সংস্কৃতি এবং এই প্রান্তিক ভাষা বলয়ের মধ্যে একটা সংহতির ভূমিকা পালন করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy