একজনের দূর্গ রক্ষার লড়াই। অন্যজনের দূর্গ দখলের। পরাজয় মানেই তিল তিল করে গড়ে তোলা ‘নেতা’ ভাবমূর্তি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাই দিনহাটা পুরসভা জয়ের লড়াইতে চেষ্টায় কসুর নেই কোনও পক্ষেরই।
নেতাদের একজন দিনহাটার বর্তমান বিধায়ক তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ। অন্যজন দিনহাটার প্রাক্তন বিধায়ক তথা তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির সদস্য অশোক মণ্ডল। সংরক্ষণের গেরোয় দু’জনেই নিজেদের বাড়ির এলাকা ছেড়ে এ বার পুরভোটে ‘বহিরাগত’ হিসাবে অন্য ওয়ার্ডে লড়ছেন। পুরসভা দখলের চেনা ছকের বাইরে তাই রীতিমতো ঘাম ঝরাচ্ছেন দুজনেই। সিংহের বিচরণ ভূমি বলে পরিচিত দিনহাটায় জোড়াফুল ফুটবে কি না পরের কথা। তবে এ বার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। বিজেপি ও কংগ্রেসের সামনে লড়াই অবশ্য খাতা খোলার।
নির্বাচন শুরুর পর থেকে টানা তিন দশক ধরে বামফ্রন্ট দিনহাটা পুরসভার ক্ষমতায় রয়েছে। বরাবর চেয়ারম্যান পদ পেয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। ২০১০ সালের পুরভোটে মোট ১৫টি আসনের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক ৯টি ও সিপিএম ৪টি আসনে জেতে। বাকি দু’টি আসন যায় তৃণমূলের দখলে। গত লোকসভা ভোটে ন’টি আসনে বামেরা, চারটিতে তৃণমূল ও দু’টিতে বিজেপি এগিয়ে ছিল। এবার ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬টি। ফব ১০টিতে, সিপিএম ৬টিতে লড়ছে। তৃণমূল ও বিজেপি ১৬টি আসনেই লড়ছে। কংগ্রেস রয়েছে ৫টি আসনে। প্রচারে পুর পরিষেবা নিয়ে চাপানউতোর চলছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে আলোচ্য বিষয় অবশ্য এলাকার বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়কের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
রাজনৈতিক মহলের খবর, অন্যবার উদয়ন গুহ ‘অভিভাবক’ হিসাবে বাম প্রার্থীদের হয়ে পুরভোটে প্রচার চালান। পঞ্চায়েত ভোটে দিনহাটায় প্রভাব বাড়িয়েছে তৃণমূল। ফরওয়ার্ড ব্লকের থেকে কোচবিহার লোকসভা আসন ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। এমন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেই প্রার্থী হয়েছেন। দিনহাটার ২ নম্বর ওয়ার্ড তফশিলীদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে তিনি লড়ছেন। ‘বসিয়ে’ রেখেছেন তিনবার ওই ওয়ার্ডে জয়ী কাউন্সিলর সমীর সরকারকে।
বিরোধীদের প্রচারে উদয়নবাবু হয়ে উঠেছেন ‘বহিরাগত প্রার্থী’। পাশাপাশি দলের প্রার্থী বদল নিয়ে নীচুতলার একাংশের ক্ষোভ সামলানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ। নিজে তো বটেই, পুরসভা জিততে না পারলে দলের অন্দরে তাঁর নেতৃত্ব নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন ওঠার অশনি সংকেত রয়েছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ বলেন, “ও সব অপপ্রচার করে লাভ হবেনা। ১৬টি ওয়ার্ডে এ বারেও ঘুরছি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে দিনহাটায় সবকটি আসনেই আমরা জিতব। মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন।” বিদায়ী ফব কাউন্সিলর সমীর সরকার বলেন, “উদয়নবাবুর সম্মান রক্ষায় শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব।” এমএ’র দূরশিক্ষার ছাত্রী তৃণমূল প্রার্থী সুস্মিতা সাহা বলেন, “আমি ঘরের মেয়ে, উদয়নবাবু বহিরাগত। এটা মানুষই বলছেন।”
অন্য দিকে, ‘বহিষ্কার’ পর্ব ভুলে ঘরে থিতু হতে চাওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক অশোক মণ্ডলও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। দলীয় সূত্রের খবর, ওয়ার্ড কমিটির প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম ছিলনা। সংরক্ষণের গেরোয় গত পুরসভা ভোটে নিজের জেতা ওয়ার্ড ছেড়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন। টানা পাঁচ বার কাউন্সিলর পদে জয়ী অশোকবাবুর সঙ্গে তাঁর ছায়াসঙ্গী বলে পরিচিত ‘সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল নেতা ’ মনোজিৎ সাহাচৌধুরীর বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে।
অশোকবাবুর ছেড়ে আসা আসনে কংগ্রেসের টিকিটে লড়ছেন মনোজিৎবাবুর স্ত্রী সুস্মিতা সাহাচৌধুরী। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ছেন তিনি। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের একাংশকে সেভাবে অশোকবাবুর প্রচারেও দেখা যাচ্ছে না বলেও শোনা যাচ্ছে। তাই তাঁর কাছে এটাও রীতিমতো ‘মর্যাদার লড়াই’। ওই ওয়ার্ডের ফব প্রার্থী সুব্রত বক্সি বলেন, “অশোকবাবু অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা সেটা সবাই জানেন।” মরিয়া অশোকবাবু প্রচারে বাড়ি বাড়ি ঢুকে কুশল বিনিময় করে বয়স্কদের প্রণাম ঠুকছেন। অশোকবাবু বলেন, “এ সব বিরোধীদের অপপ্রচার। বাইরের লোকের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছিনা। গতবারের বাম কাউন্সিলরই মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “দিনহাটার সব ওয়ার্ডেই আমরা জিতব। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যবধান সবথেকে বেশি হবে।”
আশায় কংগ্রেস ও বিজেপিও। সিতাইয়ের কংগ্রেস বিধায়ক কেশব রায় বলেন, “খাতা খোলা শুধু নয়, বোর্ড গঠনে আমরা নির্ণায়ক শক্তি হব।” দিনহাটার বিজেপি নেতা প্রবীর দে বলেন, “পদ্ম ফুটবেই। অবাধ ভোট হলে বোর্ডও পাব।”
দূর্গ দখল করে সম্মানরক্ষার লড়াইয়ে শেষ হাসি কে হাসেন, এখন তারই অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy