Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এক বৃষ্টিতেই গেল গেল

পুরোদমে বর্ষা আসার আগেই বন্যার আশঙ্কা। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতেই কোথাও নদী ফুঁসে ওঠে কাঠের সেতুর স্তম্ভ নড়িয়ে দিয়েছে, কোথাও বা সেতুর ওপরেই জল জমে গিয়েছে। সোমবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে আলিরপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দ্রুত তিনি পরিদর্শনে আসবেন। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, উত্তরবঙ্গে বর্ষা আসতে এখনও সপ্তাহখানেক দেরি। তবে প্রাক বর্ষার এক রাতের বৃষ্টিই কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে প্রশাসনে।ভোটবিধির কারণে প্রাকবর্ষায় বাঁধ মেরামতির-সংস্কারের কাজ এ বারে হয়নি বলেই দাবি সেচ আধিকারিকদের। তোর্সা নদী বাঁধের একের পর এক স্পারের মুখে থাকা তারের জালি খুলে গেলেও মেরামত করা হয়নি বলে অভিযোগ।

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০২:২৮
Share: Save:

বিপন্ন নদীবাঁধ

ভোটবিধির কারণে প্রাকবর্ষায় বাঁধ মেরামতির-সংস্কারের কাজ এ বারে হয়নি বলেই দাবি সেচ আধিকারিকদের। তোর্সা নদী বাঁধের একের পর এক স্পারের মুখে থাকা তারের জালি খুলে গেলেও মেরামত করা হয়নি বলে অভিযোগ। বাঁধের ওপরে রেনকাটের বড় বড় গর্ত তৈরি হলেও ভরাট হয়নি বলে অভিযোগ। সে কারণে গত সোমবারের বৃষ্টির তোড়ে বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা। রেনকাটের গর্ত বৃষ্টির জলে বড় হয়ে পাটল ধরিয়েছে তুফানগঞ্জ এলাকায়। কোচবিহারের অন্তত ৪০টি এলাকায় প্রথম পর্যায়ে বাঁধ, স্পার মেরামতির জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া মণ্ডলঘাটে তিস্তা নদীর বাঁধের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা বোল্ডারের দেওয়াল ধসে গিয়েছে বৃষ্টিতে। মঙ্গলবার ভোরে প্রশাসনের থেকে পরিদর্শনও হয়েছে এাকায়। উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে, মঙ্গলবার নবান্নে পাঠানো রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তিস্তা, তোর্সা, কালজানি, ডুডুয়া, বুড়িতোর্সা, মুজনাই নদী বাঁধ মিলিয়ে অন্তত ৮০ কিলোমিটার বাঁধ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সেগুলির দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন বলে দাবি করা হয়েছে। সোমবার রাতের বৃষ্টি বিপন্ন বাঁধের ক্ষতির আশঙ্কা আরও বাড়িয়েছে। উদ্বেগ বাড়ছে এলাকার বাসিন্দা এবং প্রশাসনের কর্তাদেরও।

অবরুদ্ধ হাসপাতাল

সোমবার গভীর রাতের পর থেকে ফালাকাটা হাসপাতালে ঢোকাই দায় হয়ে পড়ে। হাসপাতালে ঢোকার মূল গেট এবং বর্হিবিভাগে ঢোকার রাস্তায় প্রায় হাঁটু সমান জল জমে যায়। জলের তোড়ে রিকশা ভ্যান ঢোকা বন্ধ।

ইঞ্জিনে জল ঢোকার আশঙ্কায় গাড়ি চলাচলও বন্ধ। একমাত্র উপায় হেঁটে যাওয়া। তাতেও পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শয্যাশায়ী রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা বাইরে বের করে আনার কোনও উপায় নেই। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত এমনই দুর্ভোগ চলেছে। দুপুরের পর জমে থাকা হাঁটুজল খানিকটা কমলেও ছবিটা বদলায়নি। হাসপাতালের প্রবেশ পথের দু’পাশে নিকাশি নালা থাকলেও, তা দিয়ে জল বের হওয়ার উপায় নেই। কোথায় নালা বুজে গিয়েছে, কোথাও বা নিকাশি নর্দমার ওপরেই জবরদখল বসে গিয়েছে। বৃষ্টি জল বের হওয়ার পথ না পেয়ে জমে থাকে রাস্তার ওপরেই। মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর আত্মীয় রতন বর্মন বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি আমার কাকুকে বাইরে থেকে এক্স-রে করাতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু গেটের সামনে থাকা হাঁটু জল পার করে এক্স-রে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। অ্যাম্বুল্যান্স যেতে চাইছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে রয়েছি। জল কমছে না। এর পরে তো কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’ হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর আত্মীয়ের প্রশ্ন, ‘‘মায়ের ছুটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্ট্রেচারে শুইয়ে বের করা ছাড়া উপায় নেই। জলের জন্য তাও সম্ভব নয়। প্রশাসন কী চোখ বুজে রয়েছে?’’

সড়কেও বিপদ

আলিপুরদুয়ার থেকে ফালাকাটাগামী ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে চারটি কাঠের সেতু বেহাল। সঞ্জয় নদী, মরা তোর্সা, বুড়ি তোর্সা ও দোলং নদীর ওপরে সেতুগুলি দীর্ঘদিন ধরেই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কয়েকটি সেতুর স্তম্ভে জলে পচনও ধরেছে। সোমবারের বৃষ্টিতে বুড়ি তোর্সা নদীর জল কাঠের সেতু ছুঁয়ে ফেলেছে। বাসিন্দাদের আশঙ্কা বৃষ্টি বাড়লে সেতুই ভেসে যেতে পারে। বৃষ্টির পরে আশঙ্কায় এলাকার ব্যবসায়ীরাও। এ দিন মঙ্গলবার বেলা দুটো নাগাদ আলিপুরদুয়ার শহরের জাতীয় সড়ক ১০ বিভাগের দফতরের ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। দ্রুত সেতুগুলি পাকা না করা হলে দফতরে তালা ঝোলানোর হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসু জানান, ‘‘আলিপুরদুয়ার শহর থেকে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি বা ফালাকাটা হয়ে যেতে গেলে ওই বিপজ্জনক কাঠের সেতুগুলি পার করতে হয়। বৃষ্টিতে নদীর জল বাড়ছে। যে কোনও দিন বৃষ্টির জলে সেতুই ভেসে যাবে।’’ অন্যদিকে ময়নাগুড়ি লাগোয়া ৩১ ডি জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে বৃষ্টির জল তোড়ে বয়ে গিয়েছে। সোমবার গভীর রাতেই বৃষ্টির জল নর্দমা উপচে জাতীয় সড়কে এসে পড়ে। মঙ্গলবার ভোর থেকে প্রায় তিনঘণ্টা জলের তোড়ে জাতীয় সড়কে যান চলাচল বিপর্যস্ত হয়। যানজট ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় সড়কে।

নিকাশি আশঙ্কা

গত বছরের সেপ্টেম্বরে কয়েকঘণ্টার বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল প্রায় গোটা শিলিগুড়ি। বিধান মার্কেট থেকে সেবক রোড— সবই চলে যায় জলের তলায়। মাঝারি বৃষ্টি হলেই জলবন্দি হয়ে পড়ে জলপাইগুড়ি শহরের পাণ্ডাপাড়া, রায়কতপাড়া এলাকার বাসিন্দারাও। বর্ষার আগেই তাই জলবদ্ধতার আশঙ্কা শুরু হয় দুই শহরেই। শিলিগুড়ির ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের একাধিক জায়গা নীচু এলাকায় হওয়ায়, এখানে মাঝারি বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। জঞ্জাল অপসারণ ও পরিবেশ বিভাগের মেয়র পারিষদ মুকুল সেনগুপ্তের ওয়ার্ড ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডেও জলবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, নিয়মিত শহরের নিকাশি নালা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। যদিও নিকাশি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ মুকুল সেনগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘সমস্ত নালা নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। বর্ষার আগেই আমরা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী ভাবে করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’’ নিকাশি নিয়েও চাপানউতোর শুরু হয়েছে। পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলর প্রমোদ মণ্ডল বলেন, “শহরে জল জমা রুখতে গত এক বছরে পুরসভা কোনও কাজই করেনি৷ যে সব জায়গায় পাকা নর্দমা করা প্রয়োজন সেখানে তা হয়নি৷ আবার যে সব পাকা নর্দমা রয়েছে সেগুলিও সংস্কার করা হয়নি। তাই আশঙ্কা রয়েইছে।” তবে বিরোধীদের দাবি উড়িয়ে জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু পাল্টা বলেছেন, ‘‘শহরে বৃষ্টির জল জমা রুখতে কদমতলা এলাকায় পুরনো দুটি কালভার্ট ভেঙে নতুন করা হচ্ছে৷ আমার আশা এ বছর বর্ষায় হয়তো জলপাইগুড়ি শহরে এ বছর জলবদ্ধতার সমস্যা হবে না।”

সেতুর ওপরেই জল

বৃষ্টির জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেতুর ওপরেই। মঙ্গলবার সকাল থেকে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হল কোচবিহারের জনজীবন। দুপুর পর্যন্ত জেলাজুড়ে কখনো ভারী, কখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়। সানফোলা সেতুর খানাখন্দেও দীর্ঘক্ষণ জল জমে যায়। কোচবিহার-দিনহাটা রাস্তার তোর্সা সেতুর কিছু অংশেও বৃষ্টির জল জমে ছিল। ময়নাগুড়ির আনন্দনগরে জর্দা সেতুর ওপরেই বৃষ্টির জল জমে যায়। সেতুর ওপরে জল জমে থাকলে ফাটলের আশঙ্কাও রয়েছে। কোচবিহার জেলা প্রশাসনের তরফে ইতিমধ্যে তোর্সা নদীর সেতুগুলি পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

water-logged
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE