সমবায় গড়ে আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে আলোর পথে পা বাড়ালেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বংশীহারি ব্লকের প্রায় সাড়ে ৭০০ মহিলা। শনিবার কবিগুরুকে স্মরণ করে যাত্রা শুরু হল আলো মহিলা কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটির।
এ দিন বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে ঊষা মার্কেটে সমিতির কার্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর বংশীহারি গার্লস হাইস্কুলে মূল অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে গ্রাহকদের কয়েকজনের হাতে পাস-বই তুলে দিয়ে ওই সমিতির সূচনা করেন রাজ্যের সমবায় নিবন্ধক মুক্তা আর্য। তিনি জানান, বংশীহারি ব্লকের মহিলারা মিলিতভাবে ওই সমবায় গড়ে সাফল্যের সঙ্গে প্রাথমিক গন্ডি পেরিয়েছেন। ওঁদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আগামীতে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জেলায় এই ধরনের মহিলা পরিচালিত সমবায় গড়ে তোলা হবে। স্বল্প সঞ্চয় খাতে অর্থ জমানোর সুবিধা ছাড়াও স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মহিলারা ওই সমবায় ক্রেডিট সোসাইটি থেকে ঋণ পাবেন। ইতিমধ্যে ওই মহিলা সদস্যরা প্রায় ২ লক্ষ টাকার শেয়ার কিনে সমবায় ক্রেডিট সোসাটির মূলধন গড়েছেন। ফলে এটিকে একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করে রাজ্য সমবায় দফতর ব্যবসা শুরুর পরিকাঠামো তৈরির জন্য ১০ লক্ষ টাকা ওই মহিলা সমবায়কে অনুদান দিয়েছেন। বংশীহারি পঞ্চায়েত সমিতি থেকে কার্যালয়ে বেশ কিছু আসবাব দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে।
সমবায় আন্দোলনে কবিগুরু ছিলেন পথিকৃত। ওই আন্দোলনে নারীদের যুক্ত করার কথাও বারবার বলেছেন তিনি। তাঁর জন্মদিনে আলো মহিলা কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি সদস্যা মহিলাদের এদিন উৎসাহ ছিল দেখার মতো। চড়া রোদ ও তীব্র গরমকে তুচ্ছ করে দল বেঁধে মহিলারা শোভাযাত্রা করে বংশীহারি গার্লস হাইস্কুলের মঞ্চে সমবেত হন। প্রত্যেকের মুখের প্রত্যয় বলে দিচ্ছিল তাদের আত্ম প্রতিষ্ঠার তীব্র তাগিদ। অথচ একবছর আগেও ছবিটা ছিল অন্য রকম। ওই মহিলা সমবায় সমিতির মনোনীত চেয়ারম্যান তথা বংশীহারি গার্লসের অবসর প্রাপ্ত সহ প্রধান শিক্ষিকা অরুণা ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘গত বছর ৩ মার্চ নারীদিবসের দিনে আমরা কয়েকজন মিলে আলোচনা শুরু করি। সমবায় দফতরের আধিকারিকেরা আমাদের পিছনে ছিলেন। গ্রাম স্তর থেকে সাধারণ পরিবারের মহিলারা যুক্ত হতে থাকেন।’’ প্রথম দিকে সংসার সামলে সভা সমিতিতে উপস্থিতি নিয়ে বাড়ির কতিপয় লোকজনের আপত্তির কথা গ্রাম থেকে আসা মহিলারা বলতেন বটে, কিন্তু তাদের অনড় মনোভাবের জেরে দক্ষিণ দিনাজপুরে এই প্রথম মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত সমবায় সমিতি গড়া সম্ভব হল। শুরুতেই আমরা সাড়ে সাতশো মহিলা সদস্যকে প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছি। প্রথম দফায় হাতের কাজ থেকে আচার, জ্যামজেলি তৈরি, টেলারিং সামগ্রী তৈরি করে বাজারজাত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন তাঁরা। সভা মঞ্চের প্রাঙ্গণে বসে ওই সমবায়ের সদস্যা বুনিয়াদপুরের মৌসুমী রায় তরফদার, বরাইল এলাকার নিতু নিয়োগী, আলিগড়া এলাকার কাজলী হালদার, বর্ণালী দাস ও পারি জসমিনেরা আজ সেভিংস, রেকারিং, ডিপোজিট শব্দগুলির অর্থ বুঝে অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারেন। তাঁরা বলেন, ‘‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোজ ডিপোজিট সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সমবায় সমিতির অধীন স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়া হয়েছে। গোষ্ঠীর মেয়েরা ঋণ পাবেন। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে পথ চলা শুরু হবে।’’
ওই মহিলা সদস্যদের স্বনির্ভর করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে বংশীহারি ব্লকের সমবায় পরিদর্শক শুভাশিস গুহ জানিয়েছেন। ডিস্ট্রিক্ট কোঅপারেটিভ এডুকেশন ইনচার্জ সন্দীপ সিংহের কথায়, ‘‘বর্তমানে উদ্যোক্তা সদস্যদের মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে ১৭ জনকে নিয়ে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স গঠিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে সাধারণ গৃহবধূ থেকে শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবীরাও রয়েছেন। সমবায় আইন মেনে আগামী দেড় বছরের মধ্যে কোঅপারেটিভ ইলেকশন কমিশন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত পরিচালকমন্ডলী গঠন করবেন। তখন বোর্ডের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর।’’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিষদীয় সচিব বিপ্লব মিত্র বলেন, ‘‘সম্ভাবনা প্রচুর। চিটফান্ডগুলির গ্রাস থেকে গ্রামীণ মহিলাদের রক্ষা করে তাদের স্বল্প সঞ্চয় সংগ্রহ করে বিপুল ঋণযোগ্য তহবিল গড়া ও তাদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য জেলার মধ্যে বংশীহারি ব্লকের মহিলারা বিরাট কর্মযজ্ঞের সূচনা করলেন।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শর্ত পূরণ করতে পারলে মহিলা পরিচালিত ওই সমবায় ব্যাঙ্কিং লাইসেন্সও পেয়ে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন জেলা সমবায় কর্তারাও।