Advertisement
১৭ মে ২০২৪
রায়পুর চা বাগান

অভুক্ত শ্রমিকদের চাল-গম নিয়ে অবাধে দুর্নীতি

অর্ধাহার, অপুষ্টির কিনারা করতে গিয়ে ঝুলি থেকে বেরোল দুর্নীতির বেড়াল। রায়পুর চা বাগানে কর্মহীন শ্রমিকেরা যখন অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাচ্ছেন, তখন তাঁদের জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ চাল-গম স্রেফ ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছে। বিরোধী দল নয়, খোদ রাজ্য প্রশাসনের অফিসাররাই ওই অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে জানালেন খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। মন্ত্রী বিষয়টিকে ‘গুরুতর’ আখ্যা দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

অনির্বাণ রায়
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫১
Share: Save:

অর্ধাহার, অপুষ্টির কিনারা করতে গিয়ে ঝুলি থেকে বেরোল দুর্নীতির বেড়াল।

রায়পুর চা বাগানে কর্মহীন শ্রমিকেরা যখন অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাচ্ছেন, তখন তাঁদের জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ চাল-গম স্রেফ ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছে। বিরোধী দল নয়, খোদ রাজ্য প্রশাসনের অফিসাররাই ওই অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে জানালেন খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। মন্ত্রী বিষয়টিকে ‘গুরুতর’ আখ্যা দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রশাসনের তরফে বাগানে যাওয়া সমীক্ষকদের আশঙ্কা, ২০০৯ সালের অগস্ট থেকে এখনও পর্যন্ত শ্রমিকদের প্রাপ্য প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কুইন্টাল চাল, এবং সাড়ে চার হাজার কুইন্টালেরও বেশি গম উধাও হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে কেবল একটি চা বাগানের শ্রমিকদের প্রাপ্য থেকে এক কোটি টাকারও বেশি চাল-গম হাপিস করা হয়েছে।

রায়পুর চা বাগানে অপুষ্টিতে ভুগে জিতবাহান মুন্ডার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর রবিবার ওই বাগানে যান রাজ্যের দুই মন্ত্রী। বাগানের বাসিন্দারা জানান, তাঁরা পাচ্ছেন অতি নিম্নমানের চাল, তা-ও অনিয়মিত। বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু হতেই রেশনে বরাদ্দ চাল-গম মাঝপথে উধাও হয়ে যাওয়ার অভিযোগ সামনে এল। সরকারি নথিতে হিসেব মেলানো হল কী ভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছেপ্রশাসনের অন্দরেই।

বাগানে ২ টাকা কিলোগ্রাম দরে মাসে ২০ কেজি চাল এবং ২ টাকা কিলোগ্রাম দরে ১৪ কেজি গম শ্রমিকরা পান। সরকারি সমীক্ষকদের একাংশ জানান, দুর্নীতিচক্রটি বাজারে ন্যূনতম ১০ টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল এবং ৮ টাকা কিলোগ্রাম দরে গম বিক্রি করে দিচ্ছেন। অতীতে অন্যান্য বাগানে এমন ঘটনা ধরাও পড়েছে। সে ভাবে হিসেব করলে, গত কয়েক বছরে রায়পুর বাগানে ৬,৪৮০ কুইন্টাল চাল এবং ৪,৫৪৮ কুইন্টাল গম উধাও হয়ে গিয়েছে। চাল বাবদ অন্তত ৬৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা এবং গমে ৩৬ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা হাপিস হয়েছে। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৮ লক্ষ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।

এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবুও। তাঁর মন্তব্য, “বাগানে যে পরিমাণ রেশন প্রতি মাসে বরাদ্দ হচ্ছে, তার সবটা শ্রমিকরা পাচ্ছেন না, এমন অভিযোগ মিলেছে। গুরুতর ব্যাপার। সোমবার বিষয়টি জেনেই তদন্তের নিদেশ দিয়েছি। গরমিলে যুক্ত কাউকে ছাড়া হবে না।”

রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকদের রেশন ব্যবস্থা চালু হয় ২০০৫ সালে। তখনও বাগান বন্ধ ছিল। ২০০৯ সালে সমীক্ষার পরে চা বাগানের শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ২২৮২ জনের জন্য রেশন বরাদ্দ করা হয়। সেই থেকে ওই ব্যবস্থা চলছে। শ্রমিকদের দাবি, বর্তমানে ৫৮২ জন শ্রমিক পরিবারের রেশন কার্ড রয়েছে। খাদ্য দফতরের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে বাগান থেকে রেশন নেওয়া হয় ১৬৭৫ জনের জন্য।

খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রমিক বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হলেও, সে সব নাম নথি থেকে কাটা হয়নি। রেশন বরাদ্দ হচ্ছে। নতুন গ্রাহকদের নামও ওঠেনি। সেই হিসেবে অন্তত ৬০০ জনের রেশন বরাদ্দ প্রতি মাসে গায়েব হয়ে যাচ্ছে বলে আন্দাজ করা হচ্ছে। কবে থেকে এই ঘটনা চলছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি দফতরের কর্তারা। ২০০৯ সালের অগস্ট মাসে বাগান সামান্য সময়ের জন্য খোলে। এর পরে আর কোনও সমীক্ষা হয়নি। সেই বছর ধরলে, সাড়ে চার বছর ধরে ৬০০ ভুয়ো নামে রেশন বরাদ্দ হচ্ছে বলে প্রাথমিক ভাবে আন্দাজ করা হচ্ছে।

ভুয়ো কার্ডের সংখ্যা বাস্তবিক কত, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ দিন অফিসাররা বাগানে গিয়ে দিনভর সমীক্ষা করেছেন, কত শ্রমিকের রেশন কার্ড রয়েছে। তাতেই ধরা পড়েছে, রেশনে বরাদ্দ চাল-গমের অনেকটাই বাগানে পৌঁছয়নি। জলপাইগুড়ি জেলার খাদ্য নিয়ামক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, “রেশনের হিসেবে যে অসঙ্গতির কথা বলা হচ্ছে, তার যথাযথ তথ্য বাগানে সমীক্ষার কাজ শেষ হলে জানা যাবে।” সমাজকল্যাণ দফতর থেকেও এ দিন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির বাস্তবিক চাহিদা কত, সমীক্ষা করা হয়।

বাগানের শ্রমিকরা অবশ্য এ দিন হতাশ হয়েছেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, রবিবার খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব রায়পুর বাগানে এসে পুষ্টিকর খাবারের আশ্বাস দেওয়ার পর প্রশাসন ডিম কিংবা সয়াবিন বিলির ব্যবস্থা করবে। সেই আশায় সরকারি গাড়ি দেখে ভিড় করেছিলেন অনেকে। কিন্তু, সোমবার বাগানে রেশনের চাল আর ত্রিপল ছাড়া আর কিছু বিলি হয়নি। সুযোগ বুঝে আসরে নেমেছে বিরোধী দলগুলিও। সোমবার কংগ্রেস এবং বিজেপির দুটি প্রতিনিধি দল াগানে গিয়ে শ্রমিকদের দুধ, আলু, সব্জি বিলি করেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বাগানে শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি যান।

প্রশাসন সূত্রের খবর, রায়পুরে ১০০ দিনের কাজের পরিসংখ্যান চাওয়া হয়েছে। আগামী ৩ জুলাই নবান্নে রায়পুর চা বাগান নিয়ে শ্রমমন্ত্রী পূণের্ন্দু বসু, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী বৈঠকে বসবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

malnutrition anirban roy roypur tea garden
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE