Advertisement
০২ মে ২০২৪

উত্তরের কড়চা

“ও বৈদেশা বন্ধুরে/ও মোর সোনা বন্ধু রে/একবার উত্তরবাংলায় আসিয়া যান/আমার জায়গা খান দেখিয়া যান/মনের কথা শুনিয়া যান/বন্ধু, তোমার কথা কয়া যান রে।” ধনেশ্বর রায় রচিত ও সুরারোপিত ওই লোকগানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়েছে তাঁর কণ্ঠেই।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মনের কথা শুনিয়া যান

“ও বৈদেশা বন্ধুরে/ও মোর সোনা বন্ধু রে/একবার উত্তরবাংলায় আসিয়া যান/আমার জায়গা খান দেখিয়া যান/মনের কথা শুনিয়া যান/বন্ধু, তোমার কথা কয়া যান রে।” ধনেশ্বর রায় রচিত ও সুরারোপিত ওই লোকগানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়েছে তাঁর কণ্ঠেই। মঞ্চে উঠলে একাধিকবার ওই গান গাওয়ার অনুরোধ আসে আজও। তাঁর বাড়ির বৈঠকখানাটি ছিল লোকশিল্পী তৈরির আঁতুরঘর। প্রতিমা বড়ুয়া, কেদার চক্রবর্তী, চিন্তাহরণ দাস, সুরেন বসুনিয়ার মতো বহু গুণী শিল্পীর আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। ঠাকুরদা ব্রজেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন ‘মইশাল বন্ধু’, ‘সতী বেহুলার’ মতো বিখ্যাত লোকনাট্যগুলির রচয়িতা। বাবা-মা (নারায়ণচন্দ্র রায় ও সুনীতি রায়) দু’জনেই ছিলেন ভাওয়াইয়া শিল্পী। এ হেন সাঙ্গীতিক পরিবেশেই সযত্নে লালিত হয়েছিল তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার স্বপ্ন-সাধনা। কোচবিহারের সেই গান-বাড়ির মেয়েই এখন জলপাইগুড়ির প্রথিতযশা লোকশিল্পী দুর্গা রায়। সালটা ’৭৪-’৭৫, রবীন্দ্রসদনে, বাবার হাত ধরে প্রথম বার মঞ্চে ওঠেন দুর্গা। আয়োজক সংস্থা বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন। তার পর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরের মাটির সুর। গান শোনাবার ডাক এসেছে দিল্লি, পটনা, রাজস্থান থেকে। আমন্ত্রণ পেয়েছেন রংপুর, ত্রিপুরা, ঢাকা, আন্দামান থেকে। গান শুনিয়েছেন ২০১৩-১৪ বাংলা সঙ্গীত মেলা, কলকাতায়। সম্মানও পেয়েছেন বহু। ২০০৯-এ পেয়েছেন সুধী প্রধান স্মারক সম্মান, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি দিল্লির সম্মাননা। সরকারি বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলি থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে তাঁর গান। এ সবের পাশাপাশি থাকে গান লেখা ও সুরে বাঁধার কাজ।

বিবেক নাট্যোত্‌সব

নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাব স্বামী বিবেকানন্দের জন্মসার্ধশতবর্ষ ও শম্ভু মিত্রের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে বালুরঘাট নাট্টমন্দিরে আয়োজন করল বিবেক নাট্টোত্‌সব। ১ নভেম্বর বহুরূপী মঞ্চস্থ করল তাদের নবতম নাটক ‘মুখোশের মুখ’। মুখের মুখোশ কিংবা মুখোশের মুখই ছিল তাদের নাটকের উপজীব্য। দ্বিতীয় দিন ঋত্বিক-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘স্বাধীনতা’। সমবেত প্রয়াস-এর প্রযোজনায় ‘পরভূমে’ মঞ্চস্থ হল নাট্টোত্‌সবের তৃতীয় দিনে। নিজভূমে থেকেও পরবাসী হওয়ার যে যন্ত্রণা, সেটাই ছিল নাটকের প্রতিপাদ্য। চতুর্থ দিন মঞ্চস্থ হল কলকাতা নাট্টসভার নাটক ‘মেঘে ঢাকা তারা’। শেষ দিন উত্‌সবের সর্বোত্‌কৃষ্ট নাটক থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাপা’ মঞ্চস্থ হল।

টাউন স্টেশনের সেই রেস্তোরাঁ

তখন দেশভাগ হয়নি। আগে মেসার্স ডি সোরাবজির রেস্তোরাঁই ছিল শিলিগুড়ির একমাত্র খানদানি খাবার জায়গা। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে ওই রেস্তোরাঁ ছিল অভিজাতদের গন্তব্য। রেস্তোরাঁর অন্দরে সব কিছুই ছিল চমত্‌কার। সুদৃশ্য খাবার টেবিল। ততোধিক জাঁকজমক ছিল কাপ-প্লেট-গ্লাসে। বাহারি চামচ। নেটের ডাবল দরজা। সুন্দর পোষাক পরা বাবুর্চি, ওয়েটারও তেমন। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে তিনধারিয়া, কার্শিয়াং, দার্জিলিঙেও সোরাবজির শাখা ছিল। প্রবীণদের কাছে শুনেছি তখন কালো চামড়া মানে ‘নেটিভ’দের সেখানে নাকি সাধারণত ঢোকা বারণ ছিল।

লেখা ও ছবি: গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য।

সাহেব-মেমরা ঢুকতেন। সুরাপানের ব্যবস্থাও ছিল। দরজারা মাথায় লেখা থাকত ‘এক্সেলেন্ট রিফ্রেশমেন্ট রুম অফ মেসার্স সোরাবজি অ্যান্ড কোং’। তবে বিশিষ্ট বা গণ্যমান্য ভারতীয় যেমন লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ, জনাব ফজলুল হক প্রমুখ ভেতরে বসে আহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু, মহাত্মা গাঁধী ওই স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করলেও সোরাবজিতে গিয়েছেন কি না, জানা নেই। সোরাবজির সেই রেস্তোরাঁ এখন স্মৃতির অতলে। কিন্তু জরাজীর্ণ কঙ্কালসার সেই লোহার সিঁড়ি অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

শিশুদিবস আসে-যায়, দিন বদলায় না

শিশু দিবস আসে, শিশু দিবস যায়। দিন বদলায় না। শুধু শ্যামল, পিন্টু, সেলিনা, জরিনা নামগুলো বদলে যায়। গোটা উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি শহরে পথশিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ঠিকানা রেলস্টেশন অথবা বাস টার্মিনাস। অথবা স্রেফ ফুটপাথ। এদের বেশির ভাগই বিহারের বাসিন্দা। কেউ কেউ উত্তরপ্রদেশের। যাদের ঠিকানা নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন প্ল্যাটফর্ম, তাদের শতকরা আশি ভাগই আসে ডুয়ার্স অঞ্চল থেকে। দারিদ্র, শিক্ষার অভাব, পরিবারে অনিয়ন্ত্রিত সদস্যসংখ্যা, বস্তি এলাকার অসুস্থ পরিবেশ যেমন একটি শিশুর পথশিশু হয়ে ওঠার জন্য দায়ী থাকে তেমন এখন নতুন সংযোজন একাধিক চা-বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়া। কখনও আবার রোজগারের তাড়নায় ঘর ছাড়া। ঠিকানা বদলে কেয়ার অফ ফুটপাথ। তার পর শুধুই অন্ধকার। নিকষ আঁধারে চাপা পড়ে যায় চুরি করার বাধ্যতা, উদয়াস্ত পরিশ্রম। শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা অথবা যৌন হেনস্থার যন্ত্রণা। ভিক্ষাবৃত্তির বোবা কান্না আর নেশার রঙিন দুনিয়া নিমেষে হারিয়ে যায় অন্ধকারে। শুনলে অবাক লাগে কেউ কেউ কখনও বাড়িও যায়। ফেরার সময় সঙ্গী হয় আঁধার পথের আরও নতুন যাত্রী। অনেক সময় উত্তরবঙ্গ থেকে এদের পাচার করা হয় দিল্লি, মুম্বই বা আগ্রাতেও। কখনও অঙ্গবিকৃতি ঘটিয়ে, কখনও অক্ষত অবস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। এই সমস্যার সমাধান কী? চাইল্ড ইন নিউ ইনস্টিটিউটের উত্তরবঙ্গ শাখার সমন্বায়ক শেখর সাহার মতে, শিশু দিবস পালনের পাশাপাশি শিশু সহায়ক সমাজও গড়ে তোলা দরকার। উত্তরবঙ্গের পথশিশুর সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য নেই। পথশিশু নিয়ে প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ করাও জরুরি। প্রতিটি শিশুই যে অমূল্য, সে কথা বুঝতে হবে সমাজকে।

পেটকাটি মাও-র হাতে হাঁড়ি, ঘণ্টা, বাদ্যযন্ত্র

রাজবংশী সমাজে তিনি আরাধ্যা দেবী। ময়নাগুড়ির ব্যাংকান্দি গ্রামের মন্দিরে কৃষ্ণপাথরের মূর্তিটি পরিচিত ‘পেটকাটি মাও’ নামে। এই দেবীর পেটটি কাটা। ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর ‘রাজবংশীজ অব নর্থবেঙ্গল’ গ্রন্থে এই দেবীকে চামুণ্ডা চণ্ডী বলে উল্লেখ করেছেন। কারও কাছে ভদ্রেশ্বরী দেবী। তন্ত্রসাধনা ক্ষেত্র এই অঞ্চলটি দ্বাদশ শতাব্দীতে ছিল পাল রাজাদের শাসনাধীন। মূর্তিটির উচ্চতা সাড়ে সাত ফুট, দৈর্ঘ্যে দুই ফুট সাত ইঞ্চি এবং চওড়া সাড়ে সাত ইঞ্চি। দশভুজা দেবীর বাঁ দিকে পাঁচটি হাতের চারটিতে হাতে ধরা আছে যথাক্রমে হাঁড়ি, ঘণ্টা, ছিন্ন নরমুণ্ড ও একটি নরমূর্তি।

লেখা ও ছবি : অনিতা দত্ত।

পঞ্চম হাতটি কাটা। ডান দিকের তিনটি হাতে রয়েছে যথাক্রমে হাতির মুখ, কঙ্কাল ও বাদ্যযন্ত্র। অপর দুটি হাতই ভাঙা। দেবী সর্পালঙ্কারে ভূষিতা। মাথায় পরে আছেন সাপের মুকুট, কানের অলঙ্কারটিও সাপের। গলায় শোভিত নরমুণ্ডের মালা। কঙ্কালসার শরীরে জড়ানো সাপের মালা। উপরে বড় গহ্বর। সম্ভবত তাই দেবীর নাম ‘পেটকাটি মাও’। দেবীর শিড়দাঁড়ায় সমান্তরাল একটি বৃশ্চিক খোদিত নিপুণ ভাবে। কপালে তৃতীয় নয়ন। পয়োধর ঝুলে পড়া। পায়ের নীচে রয়েছে একটি ছোট নারীমূর্তি। দেবীর এক পাশে শেয়াল, অন্য পাশে রয়েছে প্যঁাচা। কারও মতে মূর্তিটি তিব্বত থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার কেউ কেউ একে দেশীয় শিল্পীদেরই নির্মাণ বলে দাবি করেন। এলাকার বাসিন্দাদের উদ্যোগে তৈরি মন্দিরে এই প্রাচীন মূর্তিটি ঘিরে পুজোর আয়োজন। ইতিহাসবিদ অমল গোপাল ঘোষের মতে, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মূতিটি রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিলে তা যথাযথ ভাবে রক্ষিত হবে। পাশাপাশি রাসায়নিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে প্রাকৃতিক ক্ষয় রোধ করে মূর্তিটির স্থায়িত্বও বাড়ানো যাবে। মূর্তিটি কত দিনের প্রাচীন, তা-ও পরীক্ষা করা দরকার।

এ বার রক্তকরবীও

তাঁর অভিনয় দেখে, অভিনীত চরিত্র দেখে তাকে গুণমান নামেই ডাকতেন খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। নাট্যনির্দেশক অশোক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও রয়েছে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। নাটকের ওয়ার্কশপে মনোজ মিত্রের সঙ্গলাভ তাকে সমৃদ্ধ করেছে এ কথা বলেছেন বহু বার। তাঁর হাত ধরেই জেলায় প্রথম শিশু-কিশোর নাট্য-উত্‌সব অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার ‘অনীক’-এর সঙ্গে যৌথভাবে গঙ্গা-যমুনা আন্তর্জাতিক নাট্য- উত্‌সবেরও আয়োজন করেন তিনি। তিনি হারান মজুমদার। পরের পর নাট্যোত্‌সব আয়োজনের যাবতীয় কৃতিত্ব অবশ্য তিনি দিলেন তাঁর নাট্যদল ‘শপথ’-এর সদস্য ও সদস্যাদের। তাঁর কথায়, “ওরাই সব, আমি কিছু না।” অধরা স্বপ্ন ছুঁতে এবার রক্তকরবী মঞ্চস্থ করলেন তিনি। ৭ থেকে ১১ নভেম্বর ‘শপথ’-এর আয়োজিত ‘উত্তর’-এর নাট্য-উত্‌সবের দ্বিতীয় দিনে ৮ নভেম্বর বালুরঘাট নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ হল রক্তকরবী। হারান মজুমদার বললেন, “রক্তকরবী মঞ্চস্থ করার ইচ্ছা সমস্ত নাট্যনির্দেশকেরই থাকে। আমার নাট্যদলের সবাই সাপোর্ট করাতে সাহস করলাম। আর রক্তকরবী এই সময়েও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।” পঞ্চম শ্রেণি থেকে স্কুলে নাটকের মাধ্যমে হাতেখড়ি। তার পর নাটকের জন্য গঠিত ‘গৌতম সংঘ’-এ, পাড়ায়, বালুরঘাট নাট্যমন্দিরে, রূপান্তর, অগ্নিবীণা, ত্রিতীর্থ-এ ১৪ বছর, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-এ অভিনয় এবং এখন ‘শপথ’ নাট্যদলের কর্ণধার-নাট্যকার-নির্দেশক। অভিনীত ৪০-৪৫টি নাটকের মধ্যে সেরা নাটকের কথা জিজ্ঞেস করলে গর্বিত ভাবে বললেন, দেবীগর্জন, দেবাংশী, অমিতাক্ষর-এর কথা। আর প্রিয় চরিত্র? দেবাংশী নাটকের সামসের গুণমান, পদধ্বনির সের্গেই কারচেঙ্কো, অমিতাক্ষর-এর তিষ্কাণপতি, এবং অন্য ঝুমুর-এর অধিকারী। বালুরঘাটের পরিপ্রেক্ষিতে কাল্ট হয়ে যাওয়া ‘ঝুমুর’-কে অন্যরূপে ফিরিয়ে আনা, ঢাকা পদাতিক নাট্যসংসদকে দিয়ে ‘ম্যাকবেথ’ অভিনয় করিয়ে বালুরঘাটবাসীকে তাক লাগিয়ে দেওয়া, রক্তকরবী ধরবার স্পর্ধা দেখিয়েছেন যিনি, তিনি তো ব্যতিক্রমই। থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার মানুষটির স্বপ্ন নাটককে কিছু ফিরিয়ে দেবার। নাটকের জন্য কিছু করে যাওয়ার। ‘শপথ’-এর ‘উত্তর’-এর নাট্য উত্‌সবে বিভিন্ন দিনে অংশগ্রহণ করেছে বালুরঘাট নাট্যমন্দির, শিলিগুড়ি সৃজনসেনা, জলপাইগুড়ির আনত, কালিয়াগঞ্জের অনন্য নাট্যদল।

লেখা: তুহিনশুভ্র মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

uttar karcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE