এইমস হয়নি। ফাঁকা পড়ে পানিশালার জমি। তরুণ দেবনাথের তোলা ছবি।
প্রায় ৬ বছর ধরে একটি স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতেন রায়গঞ্জের মানুষ। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলে এই শহরকে। যে স্বপ্নকে ঘিরে রায়গঞ্জ শহর তো বটেই, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল।
কী সেই স্বপ্ন? তা হল, এইমসের ধাঁচে একটা হাসপাতাল হবে রায়গঞ্জে। বিষয়টা যে কথার কথা নয়, সেটা বোঝাতে সাড়ে ৫ বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার রায়গঞ্জে ১০০ একর জমিতে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির জন্য ৮২৩ কোটি টাকা বরাদ্দও করে। সেই সময়ে জেলা প্রশাসন রায়গঞ্জের পানিশালা এলাকায় ১১০ একর জমিও চিহ্নিত করে। এর পরে কুলিক দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির কাজ আর এগোয়নি। বরং এইমসের ধাঁচে একটি হাসপাতাল কলকাতার উপকণ্ঠে কল্যাণীতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। সেই থেকে গোটা রায়গঞ্জেই যেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনার সুর।
রায়গঞ্জ শহরের যে কোনও প্রান্তে যে কারও সঙ্গে কথা বললে এইমস না-হওয়া নিয়ে ক্ষোভ-হতাশার কথা শোনা যাবে। দলমত নির্বিশেষে বাসিন্দারা একান্ত আলোচনায় আক্ষেপ করে থাকেন। তাঁদের অনেকেই জানান, ওই ধরনের একটি হাসপাতাল হলে রায়গঞ্জ ও লাগোয়া এলাকার সার্বিক চেহারাই পাল্টে যেতে পারে। কারণ, এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হলে সেখানে উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্ত ও লাগোয়া বিহারের মানুষ তো বটেই, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের লোকজনও চিকিৎসা করাতে যাবেন। ফলে, ওই হাসপাতালকে ঘিরে নানা কর্মকাণ্ড হবে। তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তারা।
পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের কর্তারা জানান, নানা সমস্যা থাকলেও এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হবে ভেবে গত ৬ বছর ধরে অপেক্ষা করে চলেছে রায়গঞ্জ। তবে হাল ছাড়তে রাজি নন শহরবাসী। মানতে চান না, তাঁদের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। ইতিমধ্যে দলমত নির্বিশেষে নাগরিক প্রতিনিধিরা মিলে সংগঠন গড়ে আন্দোলনে নেমেছেন। সেই আন্দোলন নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর চলে, তবে শেষ পর্যন্ত তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে।
অবশ্য আরও অনেক দাবি পূরণ হচ্ছে না রায়গঞ্জের। যেমন, রায়গঞ্জ থেকে কলকাতাগামী একমাত্র ট্রেন হল রাধিকাপুর এক্সপ্রেস। বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে আবেদন-নিবেদন করলেও রায়গঞ্জ থেকে কলকাতাগামী অতিরিক্ত ট্রেন মেলেনি। ফলে রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে সংরক্ষিত আসন মেলার জন্য দীর্ঘ লাইন। তাই জরুরি কাজে কলকাতা যেতে বাসের উপর নির্ভরশীল অনেকেই।
ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাধিকাপুর-বারসই ব্রডগেজ লাইন তৈরি হলেও রায়গঞ্জে এখনও পর্যন্ত পণ্য ওঠানো-নামানোর ‘রেক পয়েন্ট’ তৈরি হয়নি। তাই ব্যবসায়ীরা ডালখোলা ও মালদহের রেক পয়েন্ট থেকে রায়গঞ্জে পণ্যসামগ্রী আনতে বাধ্য হন। পরিবহণ খরচের জেরে বাসিন্দাদের বহু জিনিসের দামই বেশি দিতে হয়। গত এক দশকেও রায়গঞ্জ-বারসই রাস্তা তৈরির কাজ শেষ হয়নি। সে জন্য বারসই গিয়ে দূরপাল্লার ট্রেন ধরাও কষ্টসাধ্য।
শুধু পণ্য আনা-নেওয়া নয়, রায়গঞ্জ থেকে রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যেতেও বিস্তর ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। যে হেতু রায়গঞ্জ হাসপাতালে অনেক পরিষেবাই মেলে না। যেমন, রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে এখনও পর্যন্ত মানসিক রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবার পরিকাঠামো চালু হয়নি। গত প্রায় এক দশক ধরে পরিকাঠামোর অভাবে হাসপাতালের আইসিইউ বন্ধ। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা পান না। হাসপাতালে রোগীরা সিটি স্ক্যান, ডিজিটাল এক্সরে ও ডায়ালিসিস পরিষেবা পান না।
উপরন্তু, রায়গঞ্জের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত করার ব্যাপারে সরকারি তরফে বহু আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কাজের কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ। তা নিয়ে এলাকায় ক্ষোভও বাড়ছে। বিশেষত, টানা আর্থিক লোকসান ও কাঁচামালের অভাবে প্রায় তিন বছর ধরে জেলার একমাত্র সরকারি শিল্প কারখানা স্পিনিং মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে রয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রায়গঞ্জে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে স্পিনিং মিলের ব্যাপারে আশ্বাস দেন। ওই কারখানার কর্মীদের অন্য সরকারি দফতরে নিয়োগের আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী। কারখানার কর্মীরা জানান, সেই প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy