এই টেনিস কোর্ট ও সংলগ্ন জমি নিয়েই বিতর্ক। নিজস্ব চিত্র।
অস্তিত্বের সঙ্কটে শতাব্দীপ্রাচীন জলপাইগুড়ি ক্লাব। বৃটিশ আমলে সেটি ইউরোপিয়ান ক্লাব নামেই পরিচিত ছিল। ঐতিহ্যের সেই ক্লাবের জমি বিভিন্ন সময়ে নিয়েছে রাজ্য সরকার নিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি দফতরও রয়েছে সেখানে। এখন যে সামান্য জমিটুকু বাকি রয়েছে, সেখানে একটি টেনিস কোর্ট আছে। সেটি ও তার সংলগ্ন জমিটিও এখন রাজ্য সরকার দখল নিতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জেলাশাসকরে দফতরের তরফে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, ওই অংশটুকুতে রাজ্য বিদ্যুত্ পর্যদের একটি পাওয়ার স্টেশন করা হবে। ইতিমধ্যে শুক্রবারই জেলা ভূমি এবং ভূমি সংস্কার দফতর থেকে লোকজন গিয়ে জমি মাপজোক করাতে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন ক্লাবের বর্তমান পরিচালন সমিতির সদস্যরা।
জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকার বলেন, “জমিটি ফাঁকা পড়ে আছে। তাই মাপজোক করা হচ্ছে। কী করা হবে, তা নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
জলপাইগুড়ি ক্লাবের পরিচালন সমিতির সদস্য পীযূষকান্তি রাউথ বলেন, “শতাব্দীপ্রাচীন এই ক্লাবটির একটি অতীত ঐতিহ্য আছে। এই ক্লাবের একমাত্র টেনিস কোর্টটিও যদি রাজ্য সরকার নিয়ে নেয়, তাহলে জলপাইগুড়ি শহর তার অন্যতম প্রাচীন সম্পদ হারাবে।”
১৮৯৪ সালের ১২ নভেম্বর জলপাইগুড়ি ক্লাব কোম্পানি লিমিটেড তত্কালীন ইন্ডিয়ান কোম্পানিজ অ্যাক্ট অনুসারে নথিভুক্ত হয়। তত্কালীন বামনডাঙা চা বাগানের দুজন চা-কর, জলপাইগুড়ির একজন মেডিকেল অফিসার, একজন পুলিশ অফিসার, জলপাইগুড়ির ডেপুটি কমিশনার, বন দফতরের একজন অফিসার এবং বি.ডি রেলওয়ের একজন ম্যানেজার এবং চিফ ইঞ্জিনিয়র এই ক্লাবটিকে উদ্যোগ নিয়ে ক্লাবটিকে কোম্পানি আইনের আওতায় নথিভুক্ত করেন। এঁরা সবাই বৃটিশ ছিলেন। সেই সময়ে ক্লাবের মূলধন সংগ্রহের জন্য ১০০ টাকা মূল্যের ৭৫০টি শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়। কোম্পানি গঠনের সময় সাক্ষী ছিলেন তিন জন বৃটিশ ও একজন বাঙালি। তিনি হলেন, তত্কালীন বামনডাঙা চা বাগানের হেডক্লার্ক নন্দকুমার ঘোষ।
১৮৯৪ সালে ক্লাবের ভবন তৈরি হয়ে যায়। দোতলায় পাঁচটি দ্বিশয্যার থাকার ঘর, একটি বার, দু’টি হল, একটি বিলিয়ার্ড খেলার ঘর এবং একটি পাঠাগার তৈরি করা হয়। ক্লাবের মাঠে একাধিক টেনিস কোর্টও ছিল। পাঠাগার বাদ দিয়ে বাকি ঘরগুলি এখনও আছে। বারটিও চালু আছে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত এই ক্লাবটি পুরোপুরি ইংরেজদের করায়ত্ত ছিল। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলি থেকে চা-কররা তখন সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে এই ক্লাবে জড়ো হতেন। ১৯৪৭ সালের পর ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর ভারতীয় চা-কররা ক্লাব পরিচালনার ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেন। ক্লাবের জায়গাটি ৩০ বছরের লিজে ছিল। প্রতি ৩০ বছর অন্তর সেই লিজ পুনর্নবীকরণ করার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৫৭ সালের পর তা অনেক দিন পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। পরে ১৯৮১ সালে সেই লিজ পুনর্নবীকরণ করা হলেও সরকার থেকে নিবন্ধীকরণ করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে সার্কিট বেঞ্চ নিয়ে আন্দোলনের সময়ে এই ক্লাবটিকে অস্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ করার প্রস্তাব রাখা হয়। সেই সময় তদানীন্তন জেলাশাসক সুব্রত গুপ্তর সঙ্গে ক্লাবের পরিচালন সমিতির বিরোধ বাধে।
ক্লাবের মোট এলাকা ছিল ১১ একর। ভারতীয় চা-কররা ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী, ক্লাবের ৮.১৬৮ একর জায়গা বিভিন্ন দফতর স্থাপনের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ১৯৫৪ সালে সেচ দফতরকে ৪.০৪০ একর, ১৯৫৮ পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ দফতরকে ১.৪৪৮ একর এবং ১৯৬০ সালে ওই দফতরকে আরও ১.৬৪০ একর এবং ১৯৬০ সালে পিডি উইমেন্স কলেজকে ১.০৪০ একর জায়গা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ক্লাবের জায়গায় একটি আদিবাসী ছাত্রীদের থাকার জন্যে হস্টেল তৈরি হয়েছে। এখন ক্লাব বিল্ডিং সমেত আড়াই একর জায়গা আছে। ক্লাবের বর্তমান পরিচালকমণ্ডলীর চার সদস্যের মধ্যে রয়েছেন চা-কর পীযূষকান্তি রাউথ, প্রাক্তন চা-কর অশোকপ্রসাদ রায়, ঠিকাদার সমর সিং এবং আইনজীবী সুব্রত পাল। ক্লাবের সর্বকনিষ্ঠ বর্তমান প্রজন্মের সদস্য আইনজীবী সুব্রত পাল বলেন, “ এই প্রতিষ্ঠানটিকে সবে তার পুরনো গরিমায় ফেরানোর চেষ্টা চলছে। আমরা চাই, ক্লাবের জায়গা অধিগ্রহণ না করে রাজ্য সরকার আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুক।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy