অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া হোটেলের সামনে উত্সুক বাসিন্দারা।
ছুটি বড় না আগুন?
শিলিগুড়ির হোটেলে আগুনে পুড়ে দু’জনের মৃত্যুর পরে দমকল, পুলিশ-প্রশাসনের গা ছাড়া মনোভাব দেখে এই প্রশ্নই উঠেছে পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে। মঙ্গলবার গভীর রাতে প্রধাননগরের হোটেলে আগুন লেগেছিল। বুধবার ঘটা করে শহরের সব হোটেল, পানশালার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে বলে ঘোষণাও করে পুলিশ-প্রশাসন ও দমকল। কিন্তু, বৃহস্পতিবার দমকল, পুলিশ-প্রশাসন, কেউই কোনও অভিযান চালাননি। সব দফতরের তরফেই জানানো হয়েছে, ১ জানুয়ারি রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করায় সকলেই হালকা মেজাজে দিনটা কাটিয়েছেন। অভিযানে নামেননি কেউই। তাই হোটেলে মৃত দু’জনের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কয়েকজন প্রশ্ন তোলেন, “পর্যটকদের আগুন নেভানোর ব্যবস্থা আগে না ছুটি কাটানোটা আগে? নতুন বছরের প্রথম দিনে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি।”
শুধু তা-ই নয়, ছুটির দিন বলে যে ভাবে কাজে দেরি করা হচ্ছে, তাতে হোটেল ব্যবসায়ীদের একাংশকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে বলেই বাসিন্দাদের সন্দেহ। তাঁদের বক্তব্য, অভিযান চালানোয় দেরি হওয়ায় যে সব হোটেলে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই সে সব হোটেলে তড়িগড়ি আগুন নেভানোর যন্ত্র কিনে আনতে পারেন ব্যবসায়ীরা। তাতে পরে যখন অভিযান হবে, তখন তাঁরা সে সব দেখিয়ে ছাড়ও পেয়ে যেতে পারেন। তবে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, নতুন যন্ত্র লাগানো হলে তা অভিযান চালানোর সময় ধরা পড়ে যাবে।
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হিলকার্ট রোড, সেবক রোড, ঋষি অরবিন্দ রোড, রাজা রামমোহন রায় রোডে বিভিন্ন হোটেলগুলিতে পার্কিং আটকে অফিস বা বার-রেস্তোরাঁ হয়েছে। কোথাও পানশালা আইন ভেঙে যথেচ্ছ নির্মাণ করছে। যেখানে আগুন নেভানোর ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। সে সব দেখতে গড়িমসি করা হলে নানা প্রশ্ন উঠবেই বলে জানিয়েছেন শহরবাসীদের অনেকে।
ধৃত মালিক।
পুলিশ কমিশনার জগমোহন বলেন, “কে কী বলছেন জানা নেই। আমরা আমাদের মতো কাজ করছি।” পুর কমিশনার সোনম ওয়াংদি ভুটিয়া বলেন, “হোটেলগুলির পরিস্থিতি নিয়ে অভিযান দ্রুত শুরু করা হবে। প্রধাননগরের যে হোটেলটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, দু’বছর ধরে তাদের লাইসেন্স নবীকরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ শুনছি। আমরা তা খতিয়ে দেখছি। দমকলের ছাড়পত্র বা নিয়ম মাফিক অন্য শংসাপত্র না থাকলে হোটেলের লাইসেন্স নবীকরণ করা হয় না।” কিন্তু ঘটনার ৪৮ ঘন্টা পরেও হেটেলটির লাইসেন্সের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পুর কর্তৃপক্ষ জানাতে পারছেন না কেন?
পুর কমিশনারের জবাবেও সেই ছুটির দিনের কথাই উঠে এসেছে। তিনি জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ছুটি থাকায় সেই কাজ হয়নি। তবে লাইসেন্স বিভাগের কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার তিনি নিজেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন বলেও জানিয়েছেন।
গ্রেটার শিলিগুড়ি হোটেলিয়ার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ জানান, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শীঘ্রই তাঁরাও বিভিন্ন হোটেল মালিকদের ডেকে জরুরি বৈঠক করবেন। হোটেলগুলিতে যেন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ রাখা হয়, সে ব্যাপারে সকলকেই সতর্ক করবেন। দমকলের উত্তরবঙ্গের ডিভিশনাল অফিসার সনত্ কুমার মণ্ডল বলেন, “নিয়মিত দমকলের তরফে নজরদারি চালানো হয়। তবে এই ঘটনার পর তা আরও জোরদার করা হচ্ছে।” তার পরেও কী ভাবে হোটেলগুলিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেই, তা নিয়ে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
ঘটনার দিন দমকলের তরফে স্টেশন আধিকারিক সানিয়াল টোপ্পো হোটেল মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন। তাতে বলা হয়েছে, হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং তার পরিকাঠামো যথাযথ ছিল না। দমকল আইনে সে জন্য মামলা করা হয়। দার্জিলিঙের জেলাশাসক তথা জেলার বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগের চেয়ারম্যান পুনীত যাদব বলেন, “বৃহস্পতিবার ছুটির দিন ছিল। দফতরে কাজ হয়নি। তবে আমাদের তরফে আলাদা করে কোনও নজরদারি বা সুরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। বিষয়টি দমকলের তরফেই দেখা হয়। আমাদের কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে সেই মতো ব্যবস্থা নেব।”
কলকাতা থেকে যে সব পর্যটকেরা ঘুরতে এসেছেন শিলিগুড়িতে তাদের মধ্যে দমদম নাগেরবাজারের বাসিন্দা কাজল মুখোপাধ্যায়, তাঁর ছেলে কৌস্তভবাবু আত্মীয় গণনাথ পালরা সকলেই হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, পরিকাঠামো ঠিক না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কৌস্তভবাবু বলেন, “হোটেলটি দু’বছর ধরে পুরসভার লাইসেন্স নবীকরণ না করেই চালাচ্ছিল বলে শুনতে পেলাম। কী করে এটা হতে পারে? পুর-কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের কর্তারা কেন বিষয়গুলি দেখছেন না? অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ নেই। যা রয়েছে কর্মীরা সে ব্যাপারে কিছু জানেন না। তাতে সকলকেই বিপদে পড়তে হচ্ছে। এ সব তো দমকল, পুলিশ, প্রশাসনকে দেখতেই হবে।”
শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনার জানান, হোটেল মালিকদের অন্যতম ধৃত মণিকুমার ছেত্রীকে জেরা করে জানা গিয়েছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা থেকেই হোটেলের বিদ্যুত্ সংযোগের মিটার বক্সে গোলমাল নজরে এসেছিল। বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ বার হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে মণিবাবু এবং অন্য কয়েক জন বাড়ি চলে যান। তারপরেই রাতে ওই ঘটনা। তখনই ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত বলে পুলিশ কমিশনার মনে করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর অভিযোগ, কর্তব্যে গাফিলতি-সহ দমকলের বিভিন্ন আইনে মামলা করা হচ্ছে। এ দিন ধৃতকে শিলিগুড়ি আদালতে তোলা হলে ৩ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy