এই মরা রায়ডাক দিয়েই বাণিজ্য হত বাংলাদেশের সঙ্গে। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
এক সময়ে সকলে ফুলবাড়ি বলেই চিনতেন। সময়ের প্রবাহে এখন সেই জায়গাই তুফানগঞ্জ নামে পরিচিত।
বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। রায়ডাকের নদীপথে আগে বাংলাদেশে বাণিজ্য হত, এখন আর তা ভাবাই যায় না। মনে হয় যেন রূপকথার গল্প। শহরের রাস্তায় বিদ্যুতের আলোই এখন পথবাতির জায়গা করে নিয়েছে। বাঘের ডাক আর শোনা যায় না নতুন জনপদে। গোটা মেন রোডে পিচের প্রলেপ।
কয়েক দশক আগের রানিরহাট বাজারের হাতে গোনা দোকানপাট বেড়েছে হাজার গুণ। যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। একেবারে হাল আমলের সংযোজন রেল স্টেশন। পুরনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জায়গায় হয়েছে মানসিক হাসপাতাল। এক সময়কার দোলমেলার মাঠে এখন মহকুমা হাসপাতাল। দরিয়াবালাই রোডে পানাপুকুরে তৈরি হয়েছে আধুনিক সুইমিং পুল। নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে এলাকার ছবিও। টাউন কমিটির বদলে জায়গা নিয়েছে পুরসভা।
কী ভাবে বদলে গেল একসময়কার ছোট্ট গ্রামীণ এই জনপদ? নাম বদলের বৃত্তান্তই বা কী?
শহরের প্রবীণ বাসিন্দা থেকে ইতিহাস গবেষকরা জানাচ্ছেন, জনশ্রুতি অনুযায়ী, কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের ভাই বীর সেনাপতি চিলা রায় অধুনা তুফানগঞ্জ শহর লাগোয়া অন্দরান-ফুলবাড়ি এলাকায় দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সেই দুর্গের অন্তঃপুরবাসিনীদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করা হয় বিশাল ফুলের বাগান। গোটা এলাকার নাম হয়ে যায় ফুলবাড়ি।
এখনকার তুফানগঞ্জ বাজার চত্বরের এলাকাটির নাম ছিল রানিরহাট বাজার। কথিত আছে, রানিদের কেনাকাটার প্রয়োজনে ওই বাজার গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই তার এমন নামকরণ। রায়ডাকের খাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। প্রচলিত গল্প, এই এলাকা ঝড়প্রবণ। তার জন্যই ক্রমে এই এলাকার নাম হয়ে ওঠে তুফানগঞ্জ।
এলাকার বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক ইতিহাস গবেষক দিলীপ দে বলেন, “১৮৬১ সালের আগে পর্যন্ত কোনও সরকারি নথিতে তুফানগঞ্জ নাম পাওয়া যায়নি। সে সময় ফুলবাড়ি বলেই এলাকার পরিচিত ছিল। পরে তুফানগঞ্জ হিসেবে খ্যাত হয়েছে। ব্যাপক ঝড় তুফানের জন্য নামকরণ, এমনটাই প্রচলিত।”
শহরের বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, পঞ্চাশ-ষাটের দশক ধরে অত্যন্ত বেশি ঝড়-তুফান চলেছে। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। জনমানসে আতঙ্ক এতটাই গেড়ে বসেছিল যে বহু বাড়িতে শাল কাঠের মোটা পায়া বসিয়ে শক্তপোক্ত পাটাতনের চৌকি তৈরি করা হত। ঝড়ের সময় ছোটদের সেই চৌকির তলায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বসিয়ে রাখা হত। এ সব কথা এখনও প্রবীণদের মুখে মুখে ঘোরে।
কয়েক বছর আগে শেষ বার বড়সড় তুফানে লন্ডভন্ড হয়ে যায় শহরের চেনা ছবি। রাস্তা জুড়ে প্রাচীন গাছ উপড়ে বহু দোকান, বাড়ি দুমড়ে যায়। যা ফের অতীতের দুঃস্বপ্নকে আলোচনায় তুলে আনে। শহরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব উমাপদ রক্ষিত বলেন, “আমাদের বাড়িতেও এমন একটা চৌকি ছিল। ঝড়-তুফানের সময় ভাইবোনদের নিয়ে বহুবার তার তলায় আশ্রয় নিয়েছি। শৈশবে দেওচড়াইয়ের ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখেছি।”
ঝড়-তুফানের ধাক্কা সামলে তুফানগঞ্জ এখন সেজে উঠেছে। রাজাদের আমলে ফুলবাড়ি-চিকলিগুড়ি রোড নামে পরিচিত। এখনকার মেন রোড ধরেও টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটত। রাজা ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে টাকোয়ামারি কিংবা নাগরুরহাটের জঙ্গলে শিকারের জন্য যাওয়া। কথিত আছে, ১৯৩৬ সালে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের কাছে ওই রাস্তার হাল ফেরানোর আবেদন জানান বাসিন্দারা। তার পরেই ইটের রাস্তার বড় অংশেও পিচের প্রলেপ পড়েছে। যেখানে এক সময় বাঘের ভয় থেকে রক্ষা পেতে যেখানে ‘বুড়া ঠাকুরের’ পুজো হত। সন্ধের পরে হাটবার ছাড়া লোকের দেখা মিলত না। এখন সেখানকার ছোট-বড় সব রাস্তায় উপচে পড়ে ভিড়। কিন্তু বাড়েনি নাগরিক স্বাছন্দ্য। যা নিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy