পুতুল রাউত। ছবি: সন্দীপ পাল।
তিনি রাঁধেন, তিনি টোটোও চালান। সারদা কাণ্ডের ধাক্কায় রাজ্যের একের পর এক বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, অনান্য এজেন্টদের মতো তাঁরও মাথায় হাত পড়েছিল। আমানতকারীদের সঙ্গে নিজের জমানো টাকাও খুইয়েছিলেন তিনি। পুঁজি এবং কাজ দুই হারিয়ে, কী করবেন ভেবে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। অনেক চিন্তাভাবনা করে, গত ১৭ ডিসেম্বর হলুদ টুকটুকে রঙের টোটো বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। এখন জলপাইগুড়ি শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাত্রী নিয়ে টোটো ছোটচ্ছেন পুতুল রাউত। টোটো চালক সংগঠনের তরফে শহরের প্রথম মহিলা টোটো চালক হিসেবে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে মধ্য বয়সী পুতুল দেবীকে।
২০০৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে জলপাইগুড়ির বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন নিঃসন্তান পুতুল দেবী। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি করণিক। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কখনও সেলাই বা নানা কাজ করেছেন। পুতল দেবীর কথায়, “বাবা-ভাইয়ের সংসারে কখনওই বোঝা হতে চাইনি। বাড়িতে সকলেই আমাকে খুবই ভালবাসে, তবে বরাবরই স্বাবলম্বী হতে চেয়েছি। সে কারণে বেশ কয়েকটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্সি নিয়েছিলাম। সে কাজও যখন চলে গেল, তখন মাথায় হাত পড়েছিল। তারপর টোটো চালানোর কথা মাথায় আসে।”
অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্টের কাজ করার সময়ে নানা জায়গায় ঘুরে আমানত সংগ্রহ করতে হতো। তাই কাজের সুবিধের জন্য একটি স্কুটি কিনেছিলেন। স্কুটি চালানোর অভ্যেস থাকায়, টোটো চালানো শিখতে খুব একটা সমস্যা হয়নি।। তবে টোটো কেনাও খুব একটা সহজে হয়নি। জমানো সবই লগ্নি সংস্থায় খুইয়েছেন। প্রথমে ঋণের জন্য বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের শাখায় চক্কর কেটেছিলেন। তবে টোটো কেনার জন্য কোনও ব্যাঙ্কেই ঋণ পাননি। তারপরে পরিচিতির সুবাদে সাপ্তাহিক কিস্তিতে কিনেছেন। পুতুল দেবী জানালেন, প্রথম দফায় জোগাড় করে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এরপর সপ্তাহে ২ হাজার টাকা করে দিতে হবে। মোট দিতে হবে দেড় লক্ষ টাকার কাছাকাছি। প্রথম সপ্তাহ চালানোর পরে পুতুল দেবী যথেষ্ট অত্মবিশ্বাসী। মঙ্গলবারের শেষ বিকেলে শহরের নেতাজি পাড়ার বাড়িতে বসে পুতুল দেবী বললেন, “যিত বেশি সময় চালাতে পারব, ধার শোধ করতে তত সুবিধে হবে।”
এখন সকাল ৯ টা থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশা তথা টোটো চালানো শুরু করেন পুতুল দেবী। দুপুরের পরে ঘণ্টা তিনেক বাড়িতে বিশ্রাম। তখন বাড়িতেই টোটোর ব্যাটারি চার্জ করিয়ে নেন। ফের সন্ধ্যে থেকে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাত ৯টা পর্যন্ত টোটো চালান তিনি। তবে সন্ধ্যের পরে গাড়িতে সঙ্গে ভাইকে রাখেন। তবে শুধু টোটো চালানোই নয়, বাড়ির কাজেও হাত লাগান তিনি। খুব সকালে উঠে বাড়িতে ঘর পরিষ্কার করা সহ অন্য ঘরকন্নার কাজ। রাতে বাড়িতে ফিরেও বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হয়। বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ ভাইয়ের বৌ করলেও, ছুটির দিনে তিনিও রান্নার কাজে পুরোপুরি সময় দেন।
জলপাইগুড়ি শহর ও লাগোয়া এলাকায় এখন অন্তত দেড়শো টোটো চলাচল করে। পুতুল দেবী তাদের মধ্যে একমাত্র মহিলা সদস্য বলে জানালেন সংগঠনের নেতা কৃষ্ণেন্দু মোহান্ত। তাঁর কথায়, “পুতুল দেবী ব্যতিক্রমী। ওঁকে আমরা সংগঠনের তরফেও সংবর্ধনা দিয়েছি।” টোটো চালানো বেছে নিয়ে পুতুল দেবী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মনে করছেন পুরসভার চেয়ারমন্যান মোহন বসু। তাঁর কথায়, “পুতুল দেবীকে দেখে অনান্য মহিলারাও স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রাণিত হবে। ওঁকে উত্সাহিত করতে পুরসভার তরফে কী করা যায় ভেবে দেখব।” সমাজকর্মী দীপশ্রী রায় বলেন, “মহিলারা যে কোনও কাজেই পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন তা পুতুল দেবী প্রমাণ করলেন।” নেতাজি পাড়ার কাউন্সিলর পরিমল মালোদাস জানিয়েছেন, বরাবরই পুতুল দেবী পরিশ্রমী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy