Advertisement
০৮ মে ২০২৪

ফ্ল্যাট উঠছে রাজ-ঐতিহ্যের দিঘি বুজিয়েই

রাজবাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে যতদূরে চোখ যেত, ততদূর শুধুই সবুজ। একাধিক টলটলে জলাশয় দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে কিছু নড়াচড়া করলেও বোঝা যেত। ইতিহাস ঘাঁটলে এমনই নানা তথ্য মেলে। অথচ এখন রাজবাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে যে কোনওদিকে তাকালে নজরে পড়বে ঠাসাঠাসি করে থাকা ফ্ল্যাটবাড়ি।

শহর ভরে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গলে। কোচবিহারে হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

শহর ভরে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গলে। কোচবিহারে হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।

নমিতেশ ঘোষ
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৬
Share: Save:

রাজবাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে যতদূরে চোখ যেত, ততদূর শুধুই সবুজ। একাধিক টলটলে জলাশয় দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে কিছু নড়াচড়া করলেও বোঝা যেত। ইতিহাস ঘাঁটলে এমনই নানা তথ্য মেলে। অথচ এখন রাজবাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে যে কোনওদিকে তাকালে নজরে পড়বে ঠাসাঠাসি করে থাকা ফ্ল্যাটবাড়ি। ঝাঁ চকচকে শপিং মল। জমজমাট পানশালাও। রাজবাড়ি ঘেঁষেই তৈরি হয়েছে পার্ক। স্টেডিয়াম। বাসস্ট্যান্ডও গড়ে উঠেছে সেখানেই। সুষ্ঠু নিকাশি, সাফাইয়ের ব্যবস্থা না-থাকায় এলাকার পরিবেশের অনেকটাই এখন দূষিত বলে অভিযোগ করেন বাসিন্দারা। তাঁদের খেদ, রাজ আমলে যে পরিচ্ছন্নতা ছিল তার ধারাবাহিকতা রাখার কোনও চেষ্টাই হচ্ছে না।

কোচবিহারের প্রবীণ বাসিন্দারা পুরনো আমলের কথা উঠলেই একাধিক পুকুরের কথা টেনে আনেন। যে ভাবে রাজ আমলে খোঁড়া পুকুর দখল করে ফ্ল্যাট, দোকানপাট তৈরি হচ্ছে তা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের যুক্তি, শহরটাকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেই জলাশয় বোজাতে হতো না। অনেকেরই আক্ষেপ, রাজ আমলে যে পরিকল্পনা করে শহর তৈরি করেছিলেন মহারাজারা তা আর ধরে রাখতে পারছে না বর্তমান প্রশাসন। প্রশাসনের তরফে একাধিক আশ্বাস দিলেও আখেরে কাজের কাজ কিছু হয় না। কোচবিহারের হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “কোচবিহার শহর বড় হচ্ছে। আধুনিক হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তার সুনাম বজায় রেখে কিছু হচ্ছে না। যেদিকে তাকানো যায় শহর যেন ক্রমশই তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে।”

কেন এমন অভিযোগ? কেমনই ছিল কোচবিহার?

রাজবাড়ির নথি অনুযায়ী, কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ও জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের আমলে ছবির মতো সুন্দর করে শহরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। তৈরি হয় কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ ও মদনমোহনবাড়ি সাগরদিঘি, লালদিঘি, ধোবাদিঘি, মুস্তাফিদিঘি, কাইয়াদিঘি, শিববাড়িদিঘি, নরসিংহদিঘি, লম্বাদিঘি, চন্দনদিঘি, বৈরাগীদিঘি, মড়াপোড়াদিঘি-সহ শহরের মোট ২৭টি দিঘি। যার বেশিরভাগই রাজ আমলের নিদর্শন। কোচবিহার শহরের বিভিন্ন রাস্তার দু’ধারে ছিল বাহারি গাছ। মহারাজাদের উপলব্ধি ছিল, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে শহর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দিঘি খনন ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন রয়েছে।

কোচবিহার

পুরসভা এলাকায় ওয়ার্ডের সংখ্যা: ২০টি

জনসংখ্যা: লক্ষাধিক

আকর্ষণ: রাজবাড়ি, মদনমোহন বাড়ি, সাগরদিঘি

সেই রাজা নেই। নেই রাজ্যপাটও। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে শহরের এলাকা বাড়ছে। তা সত্ত্বেও পরিবেশ নিয়ে ভাবারও যেন কেউ নেই। মড়াপোড়াদিঘি আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। অর্ধেক ভরাট হয়ে গিয়েছে মুস্তাফাদিঘি। পাড় দখলে বিপন্ন হওয়ার মুখে লালদিঘি, চন্দনদিঘিও। ধোবাদিঘি জলা ভরাট করে বাড়ি, স্টেডিয়াম, বহুতল, বাসস্ট্যান্ড নির্মাণের নানা অভিযোগ রয়েছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত কোচবিহারে যথেচ্ছ নির্মাণ হওয়ায় শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমজনতার উদ্বেগ বাড়ছে।

রাজ আমলের সেই ঝাঁ চকচকে প্রশস্ত রাস্তার ছবিও আমূল বদলে গিয়েছে। সুনীতি রোড, কেশব রোড, বিশ্বসিংহ রোডের মতো ব্যস্ততম এলাকাতেও ফুটপাত দখল করে তৈরি হয়েছে দোকানপাট। রাজ আমলে সাধারণত রাজবাড়ি ঢাকা পড়ে যায় এমন উচ্চতার বাড়ি তৈরি নিয়ে কড়াকড়ি ছিল। তিন তলার বেশি উচ্চতার বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে দু’দশক আগেও অনুমতি পেতে বিস্তর ঝঞ্ঝাট ছিল। রাজ আমলে প্রতিটি বাড়ির সামনে জায়গা ফাঁকা রেখে উদ্যান তৈরির অলিখিত রেওয়াজ ছিল। এতেই শহর হয়ে উঠেছিল সৌন্দর্যমন্ডিত। সময়ের প্রবাহে সেই কোচবিহারেই অবশ্য এখন এক হাজারের বেশি বহুতল। সেখানে সবুজ খুঁজতে দূরবীন লাগবে বলে মনে করেন অনেকেই। প্রোমোটার রাজেরও রমরমা বেড়েছে।

বদলে যাওয়া কোচবিহার ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে ক্রমশ। একদা ‘রাজনগর’ বলে পরিচিত কোচবিহারের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮২১ সাল পর্যন্ত ভেটাগুড়ি কোচবিহারের রাজধানী ছিল। ওই বছরই কোচবিহার শহর লাগোয়া ধলুয়াবাড়িতে কোচবিহার রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। ১৮২৮ সালে কোচবিহার শহরে রাজধানী প্রত্যাবর্তন করে। অনেকের ধারণা, পুরনো রাজবাড়িতে মদনমোহন বিগ্রহ থাকায় ওই বাড়ির চত্বরে মেলা বসত। ১৮৯০ সালে কোচবিহারের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ বৈরাগী দিঘির পাড়ে মদনমোহন মন্দির স্থাপন করেন। সেই সময় থেকেই সেখানে মেলা বসতে শুরু করে বলে অনেকের ধারণা। ১৮১২ সালে ভেটাগুড়িতে শুরু হওয়া ওই মেলা কালের প্রবাহে দুশো বছর পেরিয়েছে। শহর কোচবিহারের সঙ্গে বদলেছে সেই মেলার ছবিও।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

namitesh ghosh cooch behar urbanisation policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE