Advertisement
E-Paper

বাথান হারানোয় হারাচ্ছে রাজবংশীর খাদ্য, সংস্কৃতি

হালুয়া, দমকা, খমখমা, চিকন বাগরা, ছাচিকাটা--- কত নামের দই। পাল্টে যাওয়া উত্তরের রাজবংশী জনজাতি সমাজে সবই এখন স্মৃতি। বসন্ত কালে বাঁশের চোঙায় তৈরি চাক ধরা বিশেষ টক দই পাতে দেখা মেলে না।

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৪ ০১:৫৯

হালুয়া, দমকা, খমখমা, চিকন বাগরা, ছাচিকাটা--- কত নামের দই। পাল্টে যাওয়া উত্তরের রাজবংশী জনজাতি সমাজে সবই এখন স্মৃতি। বসন্ত কালে বাঁশের চোঙায় তৈরি চাক ধরা বিশেষ টক দই পাতে দেখা মেলে না। তিস্তা ও জলঢাকা পাড়ের গ্রামীণ জীবনে ‘গলেয়া’ নামে পরিচিত এই লোকায়ত ‘রেসিপি’ কয়েক দশক আগে উত্‌সবের প্রধান আকর্ষণ ছিল। তার জায়গা নিয়েছে চলতি আইসক্রিম বা ফ্রিজের দই।

দই শিল্প রাজবংশী সমাজে ‘দোহ’ নামে পরিচিত। শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের বলা হত ‘দোহনি’। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় জানা যায়, তিস্তা, জলঢাকা ও তোর্সা নদী চর এলাকায় অন্তত পাঁচশোটি বাথান ছিল। সবচেয়ে পুরনো বাথান ছিল রংধামালিতে। রংধামালি থেকে নৌকা বোঝাই করে দই নিয়ে অধুনা ময়নাগুড়ির দোমহনি রেল বাজারে আসতেন দোহনিরা। নাথুয়াহাটে দই বিক্রি হত বুধন ও হেদলা নামে। রংধামালির দুই বিখ্যাত দোহনির নাম আজও বলেন প্রবীণরা।

লোক সংস্কৃতির গবেষকেরা মনে করেন, উত্তরবঙ্গের নদী বক্ষে জেগে ওঠা চর এলাকায় বেড়ে চলা বসতির গ্রাসে ‘বাথান’ অর্থাত্‌ বিরাট গো-চারণ ভূমি ক্রমে অস্তিত্ব হারানোয় রাজবংশী সমাজের কয়েকশো বছরের প্রাচীন বর্ণময় লোকায়ত খাদ্য-সংস্কৃতি বিপন্ন। নদীচর গ্রামীণ সমাজে মাঝিয়ালি নামে পরিচিত। সেখানে মোষের পিঠে চড়ে মৈসাল বন্ধুদের পাল নিয়ে আর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না। যে মানুষেরা বাথান থেকে বয়ে আনা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা পেশা পাল্টেছেন। তাই বিলুপ্ত হয়েছে দই শিল্প। কয়েক দশক আগে গ্রামীণ বাজারে মুখে কলাপাতা বাঁধা ছোটবড় হাঁড়িতে দই নিয়ে খদ্দেরের জন্য তাঁদের বসে থাকতে দেখা যেত।

লোকসংস্কৃতি গবেষক বিমলেন্দু মজুমদার বলেন, “প্রতি দেশে বাথান বা গোচারণ ভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে সেটা নেই। ওই কারণে লোক শিল্পের এমন দশা হয়েছে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে অনেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেত।” উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে কর্মরত গবেষক দীপক রায় বলেন, “নদী চরে বাথানগুলি ঘিরে রাজবংশী সমাজে এক দিকে যেমন মৈসাল বন্ধুর গানের মতো সঙ্গীতের ধারা তৈরি হয় অন্য দিকে বিকশিত হয় লোকায়ত দই শিল্প। বহুল প্রচলিত গলেয়া অথবা টক দই এই বাথান সংস্কৃতির অন্যতম একটা অবদান ছিল।” প্রবীণ বাসিন্দা নিত্যানন্দ অধিকারীর দাবি, “পাইলা নামে মাটির হাড়িতে কাঁচা দুধ থেকে তৈরি ‘গলেয়া’ দই ঋতু পরিবর্তনে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’-এর কাজ করত।” জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা এই দাবি উড়িয়ে দিতে পারেননি। জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগ্ননাথ সরকার বলেন, “অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠা খাদ্যাভাসের মধ্যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে। টক দইয়ে ল্যাকটোব্যাসিলাস থাকে। সেটা হজম ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়াও টক দই রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও গড়ে তোলে।”

বোদাগঞ্জের বাসিন্দা নগেন্দ্রনাথ রায় জানান, ককেয়া নামে বাঁশের চোঙায় তৈরি খমখমা দই আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল। হালুয়া, দমকা, চিকনবাগরা অথবা ছাচিকাটার মতো দই গরুর গাড়িতে বোঝাই করে রংপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হত। ময়নাগুড়ির মাধবডাঙা গ্রামের ৮৬ বছরের বিশ্বেশ্বর রায় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন, “সেই সবই এখন স্মৃতি।”

rajbongshi batham biswajyoti bhattacharya jalpaiguri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy