গাছগাছালিতে ভরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে কী ভাবে ছোট্ট একটি জনপদ শিলিগুড়ির মতো শহরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দিকে এগোচ্ছে, তারই যেন দৃষ্টান্ত হতে পারে শিবমন্দির। কী ভাবে গণ্ডগ্রাম থেকে আস্ত একটা শহর হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছে শিবমন্দির, তা একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখে নেওয়া যাক।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সবে এক দশক কেটেছে। তখন শিলিগুড়ি মফস্সল থেকে শহর হওয়ার পথে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-সহ নানা উন্নয়ন মূলক কাজকর্ম তখন শিলিগুড়িকে ঘিরেই। সেই সময়ে শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে বালাসন ও লচকার মাঝামাঝি জনপদের বাসিন্দা তথা হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার নিজেদের এলাকার উন্নয়নের জন্য কোমর বেঁধে আসরে নামে। কারণ, শিলিগুড়ির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ফাঁকা জমি ছিল ওই জনপদে। বালাসনের ধার ঘেঁষে মাইলের পর মাইল ধূ ধূ খেত। সবুজে-সবুজ। তখনই এলাকার বর্ধিষ্ণু পরিবারের তৎকালীন কর্তারা ওই জমি অন্য কাজে লাগানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ষাটের দশক শুরুর মুখে সরকারি তরফে শিলিগুড়িতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে খবর পাওয়া মাত্র আঠারোখাইয়ের তৎকালীন প্রভাবশালী পরিবারের কর্তারা দার্জিলিং জেলা সদরে ছোটাছুটি শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া মানে দু-দশ বিঘা জমির ব্যাপার তো নয়। দার্জিলিং জেলা প্রশাসনের নথি বলছে, তখন এক লপ্তে অন্তত ৫০০ বিঘা জমির খোঁজ করছিল শিক্ষা দফতর। আঠারোখাইয়ের একাধিক পরিবার তখন এককাট্টা হয়ে গিয়েছিলেন। সকলের সম্মিলিত জমির পরিমাণটা প্রায় ১ হাজার বিঘা। পর পর সেই খেতগুলি। কোথাও ছিল জঙ্গলও। জমিদাতাদের আগ্রহ দেখে তৎকালীন জেলা প্রশাসন, শিক্ষা দফতরের কর্তারা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলে নথি থেকে জানা যাচ্ছে। শিক্ষা দফতরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী তথা শিবমন্দির এলাকার বাসিন্দা জানান, এখন কোথাও এক লপ্তে ১ হাজার বিঘা জমি সরকারি কাজে নিতে গেলে অন্তত ১০ হাজার ঝামেলা পোহাতে হবে। তাও শেষ পর্যন্ত জমিটা মিলবে বলে ওই সত্তরোর্ধ্ব শিক্ষাকর্মী মনে করেন না। ওই শিক্ষাকর্মীর কথায়, “যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আঠারোখাইয়ের শিক্ষানুরাগী পরিবারের কর্তাদের ইচ্ছে পূরণ হয়। ১৯৬২ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হয়।”
ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দেওয়া নিয়ে যাঁরা দার্জিলিঙে ছোটাছুটি করেছেন, তাঁদেরই একজন হলেন প্রয়াত কালিপ্রসাদ সিংহ। শিবমন্দিরের বিবর্তনের সঙ্গে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কালিপ্রসাদবাবুর নামও পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে। তাঁর ছেলে স্বপনবাবু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
স্বপনবাবু বলেন, “ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ইতিহাস। বাবা যখন প্রথম জানতে পারেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে দার্জিলিং জেলায়, তখনই দার্জিলিং জেলা প্রশাসনের সদর কার্যালয়ে মানে পাহাড়ে গিয়ে তদ্বির করেন। আমাদের পরিবারের জমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। আরও একাধিক পরিবার দিয়েছে। তখন তো জমি দেওয়া, অধিগ্রহণ নিয়ে ঝামেলা হয়নি। বরং বাবা ও তাঁর সম মনোভাবাপন্নরা যৎসামান্য দামে জমি দিয়ে এলাকার উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের এখানে হয়েছে।” সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে এলাকার চেহারা বদলাতে শুরু করে। অধ্যাপক, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের থাকার জন্য বাসস্থান তৈরি হতে থাকে। শিবমন্দির ও লাগোয়া এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে আঠারোখাই গ্রাম পঞ্চায়েত। সেই পঞ্চায়েতের আওতায় থাকা এলাকাতেই আজও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এলাকার চেহারা দেখলে মনে হবে তা আদ্যন্ত শহর। ছোটখাটো কাঠের বাড়ির ক্রমশ অদৃশ্য। আঠারোখাইয়ের পাড়ায়-পাড়ায় ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির হিড়িক পড়েছে। ৩-৪ তলা ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা শতাধিক পেরিয়ে গিয়েছে। আরও অন্তত ২০০টি ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
কদমতলা থেকে ফাঁসিদেওয়া মোড়ের দিকে যাতায়াত করতে গেলেই ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির হিড়িক দেখা যায়। পশ্চিমে শিক্ষা দফতরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের আঞ্চলিক অফিস। দক্ষিণে খয়রানিজোত, সর্বত্রই ইতিউতি নির্মাণের ছবি চোখে পড়ে। অবশ্য জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। সে জন্যই এলাকায় ঘরবাড়ি তৈরির প্রবণতাও বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও শিক্ষা দফতরের একাধিক অফিস, আইন কলেজ, বিএড কলেজ, একাধিক স্কুল হয়েছে। ফলে, জনবসতির ঘনত্বও বাড়ছে। সেই অনুপাতে দৈনন্দিন নাগরিক পরিষেবার হাল কিন্তু ফিরছে না বলে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমশ দানা বাঁধছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy