এর আগে দৌড়ের জন্য রাজার কপালে শুধু গালমন্দই জুটেছে। গত বৃহস্পতিবারই প্রথম দৌড়ের জন্য পুরস্কার পাওয়া। দশ বছরের বড় দাদা স্কুলের বদলে পাড়ার দোকানে কাজে ঢুকিয়ে দেয়। কাজে মন না লাগায় সেখান থেকে ছুট লাগিয়েছিল রাজা। বাড়ি ফিরে উত্তম মধ্যম। রাতে বাড়ি থেকে ফের দৌড় স্টেশনের দিকে। ট্রেনে উঠে তাড়া খেতে হয়েছিল আরপিএফের। নেমে পড়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। বছরখানেক ধরে এই স্টেশনে রয়েছে কিসানগঞ্জের রাজা। এ দিন প্ল্যাটফর্মে থাকা শিশু কিশোরদের নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে পুরস্কার পেয়েছে রাজা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল মহম্মদ জামাল। অঙ্কে এক বার পুরো নম্বর পেয়েছিল। এ দিন অঙ্ক কষে দৌড় প্রতিযোগিতায়, সকলের আগে অঙ্ক করে ছুটে গিয়েছিল দৌড়ের ‘ফিনিশিং পয়েন্টে’র দিকে। বেঁধে রাখা লাল ফিতে ছিঁড়ে জড়িয়ে গেল জামালের শরীরে। কিন্তু অঙ্ক খাতাটা যে মাঠেই ফেলে এসেছিল। তাই ফস্কে গিয়েছে প্রথম পুরস্কার। মাস তিনেক আগে জামালও বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। বিহারের কয়েকটা স্টেশন ঘুরে নিউ জলপাইগুড়ির প্ল্যাটফর্ম। বাড়ির কথা কিছুই বলতে চায় না বছর এগারোর জামাল। সব প্রশ্নে জামালের একটাই উত্তর, “আমি কিন্তু সকলের আগে অঙ্ক শেষ করতে পেরেছি।”
নিউ জলপাইগুড়ি শিশু সুরক্ষা কমিটির উদ্যোগে এ দিন স্টেশন লাগোয়া মাঠেই বার্ষিক খেলা অনুষ্ঠিত হল। প্ল্যাটফর্মে থাকা অনাথ এবং ভবঘুরে শিশু কিশোরদের নিয়ে এ ধরনের খেলার আয়োজন এই প্রথম। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্ল্যাটফর্মে শিশুদের দেখভালের কাজ করে। ওই সংগঠনগুলিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে শিশু সুরক্ষা কমিটি। ৩৩ শিশু কিশোর ১১টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। দৌড়, লঙ্ক জাম্প, অঙ্ক কষে দৌড়, আলু কুড়োনো দৌড়, রিলে রেসে জমজমাট হয়ে ওঠে স্টেশন লাগোয়া মাঠটি। নিউ জলপাইগুড়ির রেল পুলিশের ইন্সপেক্টর কোকিল রায় কমিটির সদস্য। কোকিলবাবুর কথায়, “ঘটনাচক্রে কিছু শিশু কিশোরের ঠাই হয় প্ল্যটফর্মে। ওদের দেখভালের জন্য সকলকে নিয়ে কমিটি হয়েছে। ওদের পড়াশোনা এবং খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। খেলায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ওরাও যে মুলস্রোতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এটা উপলব্ধি করবে।” রাজা, জামাল, সুনীল, রাহুল, লিটিল, দীপক। কার বাড়ির ঠিকানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার খাতায় লেখা রয়েছে। কেউ আবার বাড়ির ঠিকানা ভুলে গিয়েছে বলে দাবি করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এটা ওটা কুড়িয়ে দিন কাটে। কেউ ট্রেনে ঝাড় দেয়। রাতে প্ল্যাটফর্মের কোণার অন্ধকারে কারও হাতে দেখা যায় নিষিদ্ধ কোনও মাদক। স্টেশনে ঢোকার মুখে জিআরপি ব্যারাকের ৩টি ঘরে শিশু কিশোরদের থাকার ব্যবস্থা করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা। দুপুরে পড়াশোনাও করানো হয়। এ দিনের প্রতিযোগিতার মূল উদ্যোক্তা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদক তাপস কর্মকারের কথায়, “প্ল্যাটফর্মে মুলস্রোতে ফেরানোর জন্য অনেক রমক উদ্যোগ নেওয়া হয়। খেলা প্রতিযোগিতা তারই অন্যতম। ওদের সকলকেই পুরস্কৃত করা হয়েছে।”
বছরে একবার খেলা প্রতিযোগিতা করে আদৌও কী শিশুদের মূলস্রোতে ফেরানো সম্ভব! তাপসবাবুর কথায়, “কখনওই না। তবে ওদের প্রত্যেকেরই ভিতরে কোনও না কোনও দুঃখ ও যন্ত্রণা রয়েছে। সেটি জানতে নিয়মিত কাউন্সিলিং চলছে।” এই দিন দৌড়ে পুরস্কার পাওয়া রাজা যেমন জানাল, “বাবা মরে গেল। তার পর বাড়িতে সবাই মারত। দুই দাদা, বৌদি সবাই।” আর মা। মা ভালবাসত না? কিথু না বলে এক ছুটে পালিয়ে গেল রাজা। মাঠ পেরিয়ে, প্ল্যাটফর্মের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy