বর্ষাকাল নয়, তবে সুভাষপল্লি বাজারের ভিতর এখনও এমন জলকাদায় ভরা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
কোনও বাজারে ঢুকলেই দেখা যাবে মুরগির পালক উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কোথাও নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাস্তায় কুকুরের কাড়াকাড়ি। কোথাও মাছের আঁশ ডাঁই করে রাখা। মাছ-মাংস বিক্রেতার স্টলের গা ঘেঁষেই অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার থেকে ভেসে আসছে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ। শাক-সব্জির বাজারের নর্দমায় জঞ্জাল জমে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে পুতিগন্ধময়। কোথাও আবার মাছবাজারের রক্ত, পচা শাক-সবজি মিলেমিশে বাজার যেন নরককুণ্ড! অন্তত ভুক্তভোগী শহরবাসীর অভিজ্ঞতা তাই বলছে।
শিলিগুড়ি শহরের পুর এলাকার মধ্যে থাকা ২০টি বড় মাপের শাক-সব্জি, মাছ-মাংসের বাজারের হাল কমবেশি এমনই বেহাল। অথচ শিলিগুড়ি শহরের রাস্তা ক্রমশ খোলতাই হচ্ছে। ভাল রাস্তার উপরে প্রলেপ দিয়ে আরও পাকাপোক্ত করতে খরচ করা হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। তাই রাস্তার কাজ তাড়াতাড়ি করাতে নেতা-মন্ত্রী-আমলা ও ঠিকাদারদের ছোটাছুটি চোখে পড়ছে অনেক শহরবাসীরই। তা হলে শহরবাসীর নিত্য যাতায়াত যেখানে, সেই শাক-সব্জি, মাছ-মাংসের বাজারের চেহারা কেন আরও হতশ্রী হবে কেন সেটাই বাসিন্দারা অনেকে বুঝতে পারছেন না। কারণ, সবচেয়ে প্রাচীন ডিআই ফান্ড মার্কেট থেকে সুভাষপল্লি বাজার, সর্বত্র প্রায় একই বেহাল দশা।
শহরের অন্যতম প্রাচীন বাজার সুভাষপল্লির কথাই ধরা যাক। শিলিগুড়ি শহরের বাসিন্দা তথা প্রাক্তন ও বর্তমান, দুই মন্ত্রী, যথাক্রমে অশোক ভট্টাচার্য উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব সুভাষপল্লি বাজারটাকে হাতের তালুর মতোই চেনেন। শাক-সবজি, মাছ-মাংস বিক্রেতাদের অনেককে নাম ধরেও ডাকেন। ওই বাজারে যে এখনও পরিচ্ছন্ন সুলভ শৌচালয় গড়ে ওঠেনি সেটাও নেতা-কর্তাদের অজানা নয়। বাজারের মাছ-মাংস বিক্রেতাদের একটা চরম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসে ব্যবসা করতে হয় সেটাও সকলে জানেন। সেখানে যে ক্রেতারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তাঁরাও কার্যত নিরুপায় হয়ে ওই বাজারে যান।
ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীরা জানান, বাম আমলে ওই বাজারটিকে আধুনিক করতে উদ্যোগী হয়েছিল পুরসভা। সে সময়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা বাজারটির সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তত্কালীন পুর চেয়ারম্যান অশোক ভট্টাচার্য। পরে যিনি পুরমন্ত্রী হন। তাঁর মন্ত্রিত্বের সময়ে শিলিগুড়ি পুরসভা ওই এলাকায় একটি তিন তলা বাজার তৈরির কাজে নামে। সেই কাজও প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু, নানা জটিলতায় বাজারের দোতলা চালুই হয়নি। ওই নয়া ভবনের নিচেই আধো অন্ধকারে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বসছে মাছ বাজার।
শিলিগুড়ির বেশ কয়েকজন চিকিত্সক নিয়মিত ওই বাজারে যাতায়াত করেন। তাঁদের একাংশের মতে, ক্রেতারা তো বাজারে সামান্য সময় থাকেন। কিন্তু, বিক্রেতারা ওই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলে তাঁদের নানা ধরনের রোগের আশঙ্কা থেকে যায়। যে পরিকাঠামো রয়েছে সেটিকে আলোকিত করে, দুর্গন্ধের উত্স বন্ধ করলেই বাজারের চেহারা অন্যরকম হতে পারে বলে তাঁরা জানান। সে জন্য বাজারের দোতলাও ব্যবহার করা দরকার। বিশেষত, মাংস বিক্রেতারা যে ভাবে খোলামেলা ভাবে ব্যবসা করছেন তা চরম অবৈজ্ঞানিক ও ভয়ঙ্কর দূষণ ছড়ায় বলেও পরিবেশবিদরা অভিযোগ করেন।
এ কথা মানছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুও। তিনি বলেন, “আমরা তো তবুও উদ্যোগী হয়ে বাজারের আধুনিকীকরণের কাজটা শুরু করেছিলাম। অনেকটাই কাজ হয়েছিল। এখন বিক্রেতারা যে পরিবেশে দিনভর ব্যবসা করেন তা কষ্টকর। ক্রেতাদেরও ন্যূনতম পরিষেবা মেলে না। বয়স্ক ক্রেতারা সাতসকালে বাজারে গেলে শৌচাগারের দরকার হতে পারে। সে জন্য সুলভ শৌচালয়ের পরিকল্পনা আমাদের সময় করেছিলাম। সেই কাজটাও গত ৫ বছরে পুরসভা করাতে পারেনি।” তাঁর প্রশ্ন, গত ৫ বছরে পুরসভা সুভাষপল্লি বাজারের জন্য কিছুই কেন করতে পারল না সেই প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা আগামী দিনে চাইবেন।
বস্তুত, শহরের সব বাজারই কমবেশি এমন বেহাল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন লাগোয়া বাজারের কথা ধরা যাক। ধূপগুড়ি এবং হলদিবাড়ি দুই জনপদের সঙ্গে নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দুই জনপদ থেকে তাজা শাক-সব্জি ট্রেনে নিয়ে আসা হতো নিউ জলপাইগুড়িতে। তখন স্টেশনেই সব্জি কিনতে উপস্থিত হতেন আড়তদার, মহাজনেরা। যে সব্জি বিক্রি হতো না, সেগুলি নিয়ে ধূপগুড়ি, হলদিবাড়ির কৃষকরা স্টেশন লাগোয়া এলাকাতেই বসে বিক্রি করতেন। কালক্রমে তা নিয়মিত বাজারের চেহারা নেয়। ছ’দশকেরও বেশি সময় পরে সেই বাজারে এখন বিক্রেতার সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদিও বাজারের পরিকাঠামো খুব একটা বদলায়নি।
ব্যবসায়ীদের দৈনিক চাঁদায় বাজারে ৩টি শেড তৈরি করা হয়েছিল নয়ের দশকে। সংস্কারের অভাবে টিনের শেড জরাজীর্ণ। দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের চলাফেরা করতে হয়। প্রায় ৭০০ বিক্রেতা। বেশির ভাগ বিক্রেতাকেই বসতে হয় খোলা আকাশের নীচে। জল জমে থাকায় গ্রীষ্মেও মাটি ভিজে থাকে।
বাজার কমিটির সভাপতি বীরেশ্বর দাসের কথায়, “বাজারে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার ক্রেতা আসেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাজার চলে। এতবড় একটি বাজার সংস্কারে কোনও সরকারি সাহায্য আমরা পাইনি। বিক্রেতাদের থেকে চাঁদা তুলে একসময়ে শেড তৈরি হয়েছিল। না হলেও তাও হতো না। পুরসভা থেকে প্রশাসন সকলের কাছেই দরবার করেছি, কোনও ফল মেলেনি। এখন ভয়ে থাকি, শেডের যা অবস্থা তাতে কোনও অঘটন না ঘটে যায়।”
নিউ জলপাইগুড়ি বাজারে নিয়মিত আসেন একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক সংস্থার সহকারী আঞ্চলিক বিক্রয় আধিকারিক সুপ্রতিক ঘোষাল। তাঁর কথায়, “অন্তত দশ বছর ধরে এই বাজারে আসছি। কোনও উন্নতি চোখে পড়ে না। উল্টে প্রতিদিনই বাজার ঘিঞ্জি হচ্ছে। যত্রতত্র আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে। ধাক্কা খেয়ে চলাফেরা করতে হয়। এটাও তো নাগরিক পরিষেবা, প্রশাসনের কী এ দিকে নজর পড়বে না।” আবার শিলিগুড়ির হায়দরপাড়া বাজারের প্রধান সমস্যা হল সেখানেও কোনও শৌচাগার নেই। বাজার কমিটির সম্পাদক নিমাই পাল জানান, মাছ বাজার, সব্জিবাজার মিলিয়ে প্রায় ১০০ টির বেশি দোকান রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ বাজার করতে যান। তাঁরা অসুবিধায় পড়েন।
শিলিগুড়ি শহরের অলিগলি ঘুরে যিনি অতীত ও বর্তমানের তুলনা করে একাধিক বই লিখেছেন, সেই গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের তাই আক্ষেপ, “শহরের বাজারগুলি যেন নরককুণ্ড! ভয়ঙ্কর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটালে ব্যাজার মুখে ফেরা ছাড়া উপায় কী?”
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-শহরের নাম’। অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর-শহরের নাম’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৬/৮৯ চার্চ রোড, শিলিগুড়ি ৭৩৪০০১। প্রতিক্রিয়া জানান এই ফেসবুক পেজেও: www.facebook.com/
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy