ফল প্রকাশের পরে। —নিজস্ব চিত্র।
দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে যে এগোতে হবে তা ওঁরা জানেন। অভাব, সমস্যা তাই দমাতে পারেনি সুমা দত্ত, সুব্রত হালদার, পাপাই হালদার, রাখি দত্তের মতো মেধাবী পড়ুয়াদের।
সুব্রতর কথাই ধরা যাক। তাঁর বাবা প্রভাতবাবু মাছ বিক্রেতা। ফুটপাথে কারবার। ৪ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে সুব্রতকে পড়ার ফাঁকে তাই রঙের কাজও করতে হত সংসারের জন্য। দুই দাদার এক জন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং অপর জন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছেন। পড়াশোনা ছেড়ে দেবার অবস্থা হয়েছিল সুব্রতরও। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। সুব্রতবাবুও ধারদেনা করে বইপত্র কিনে দিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ৬৭.৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে তাই স্কুলের শিক্ষক, পড়শিদের প্রশংসা পাচ্ছেন সুব্রত। শিলিগুড়ির ঘোঘোমালি হাই স্কুলের কলা বিভাগের ছাত্র সুব্রত পান ৩৩৯। সুব্রত বলেন, “এ বার নিজের পড়াশোনা চালাতে গৃহশিক্ষকতা করব ভেবেছি। রঙের কাজ আর করতে চাই না।”
ওই স্কুলেরই সুমা দত্ত ৩৬০ পেয়ে স্কুল সেরা। ফালাকাটার ভুটনিরহাটে বাড়ি সুমার। বাবা সুজিতবাবুর সামান্য জমি রয়েছে। চাষ আবাদ করে সংসার চালান। মা গৃহবধূ। অভাবের সংসারে মেয়েকে পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ্য তাঁদের নেই। পড়াশোনার জন্য শিলিগুড়ির নিরঞ্জন নগরে সুমাকে ছোট ভাইয়ের বাড়িতে রেখে আসেন মা। মাধ্যমিকে এই স্কুল থেকে ৫১৩ নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলেন সুমা। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করার পরে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করে স্নাতক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
সুমার মামার বাড়ির পাশে বাড়ি পাপাইদের। ৩৩৫ পেয়েছেন পাপাই হালদার। বাবা মনোহরবাবু সুভাষপল্লি বাজারের সব্জি বিক্রেতা। মা মণি দেবী গৃহবধূ। কষ্ট হলেও পাপাই এবং অপর ছেলে বাপনের পড়াশোনার জন্য সমস্ত সহ্য করতে তারা প্রস্তুত। পাপাইকে ৩ জন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ানোর জন্য খরচ জোগাড় করতেন মনোহরবাবুই। তাদের মুখ রেখেছেন পাপাই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার রায় বলেন, “স্কুলে প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েরা বেশি ভর্তি হন। অধিকাংশরই পরিবারই গরিব। তার মধ্যে কষ্ট করে পড়াশোনায় ভাল করায় তারা স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরাও তাদের জন্য গর্বিত। ওদের দেখে অন্যরাও উৎসাহ পাবে।”
শিলিগুড়ি গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী রাখি দত্ত। বাবা স্বপনবাবু জড়িবুটির ব্যবসা করেন। তাও হৃদরোগে শরীর অসুস্থ হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে দোকানে যান না। ডাবগ্রামে সূর্যনগরের বাড়িতে বসেই কোনও রকমে কারবার করেন। দাদা প্রান্তিক দত্ত শিলিগুড়ি বয়েজ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। রাখির পড়াশোনার বিষয় স্বপনবাবুই দেখেন। দু বছর আগে মাধ্যমিকে ৬২৩ নম্বর পেয়ে পাশ করে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। তবে আর্থিক সমস্যার কারণেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার বদলে কলা বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় রাখিকে। তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৫৭ পেয়েছেন। রাখি বলেন, “আমি এখন ভুগোল নিয়ে পড়তে চাই।” শিলিগুড়ি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সেফালি সিংহ বলেছেন, “পরিবারে অভাবের কারণে রাখি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারেনি। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুলের কৃতী ছাত্রীদের মধ্যে ও রয়েছে।”
সূর্যসেন কলোনির বাসিন্দা বর্ণালী পালকেও অভাবের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা করতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে তিনি পেয়েছেন ৪০৭। শিলিগুড়ির জোৎস্নাময়ী গার্লস স্কুলে সেরা কলা বিভাগের এই ছাত্রী। বাবা হারাধনবাবুর মোমোর দোকান রয়েছে। বর্ণালীরা ৩ বোন। দুই দিদি এমএ পড়ছেন। মোমো বিক্রি করেই ৩ মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয় হারাধনবাবুকে। তার মধ্যেও ৫ গৃশিক্ষকের কাছে বর্ণালীর পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। ভূগোল নিয়ে পড়ে শিক্ষকতা করতে চান বর্ণালী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy