Advertisement
E-Paper

শালপাতা, ঠোঙা হঠিয়ে দাপট প্লাস্টিকের

সত্তর দশকেও শিলিগুড়ি শহরের রাস্তার ধারে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেত ব্যবহৃত শালপাতার বাটি, মোড়ক। শহরের চৌহদ্দিতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ছিল ভার। মিলবেই বা কী করে! ষাটের দশকের গোড়ায় সুইডিশ ইঞ্জিনিয়র স্টেন গুস্তাফ থুলিন সবে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বানানোর প্রযুক্তি তৈরি করেছেন। তার পেটেন্টও নিয়েছেন। এর পরে তা ইউরোপ হয়ে এশিয়ায় পৌঁছয়। ততদিনে সত্তর দশকের অর্ধেক সময় কেটে গিয়েছে। সেই অর্থে আশির দশক থেকেই শিলিগুড়িতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ঢুকতে শুরু করে। বছর দশেকের মধ্যে তা হইহই করে ছড়িয়ে পড়ে শহরের আনাচে-কানাচে।

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের ব্যবহার চলছেই। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের ব্যবহার চলছেই। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

সত্তর দশকেও শিলিগুড়ি শহরের রাস্তার ধারে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যেত ব্যবহৃত শালপাতার বাটি, মোড়ক। শহরের চৌহদ্দিতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ছিল ভার। মিলবেই বা কী করে! ষাটের দশকের গোড়ায় সুইডিশ ইঞ্জিনিয়র স্টেন গুস্তাফ থুলিন সবে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বানানোর প্রযুক্তি তৈরি করেছেন। তার পেটেন্টও নিয়েছেন। এর পরে তা ইউরোপ হয়ে এশিয়ায় পৌঁছয়। ততদিনে সত্তর দশকের অর্ধেক সময় কেটে গিয়েছে। সেই অর্থে আশির দশক থেকেই শিলিগুড়িতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ঢুকতে শুরু করে। বছর দশেকের মধ্যে তা হইহই করে ছড়িয়ে পড়ে শহরের আনাচে-কানাচে।

শিলিগুড়ি জংশনের সত্তরোর্ধ্ব চা-সিঙ্গাড়া বিক্রেতা সন্তোষ মোদক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, সে সময়ে শহরে বৈকুণ্ঠপুরের বনের শালপাতা দিয়ে তৈরি থালা, প্লেট, মোড়ক আসত। ঠোঙার চল ছিল খুব। নিউ জলপাইগুড়ির প্রৌঢ় ডিম বিক্রেতা রামাবতার মাহাতোর কথায়, “আশির দশকের মাঝামাঝি অবধি এনজেপিতে কোথাও তেমন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ চলত না। আমরাও শালপাতা, কাগজে বিক্রি করেছি। এখন তো নানা রঙের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ এসে সব বাজার দখল করেছে।”

বস্তুত, এখন এনজেপি থেকে শিলিগুড়ি জংশন, শালুগাড়া থেকে আমবাড়ির মোড়, অলিগলিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ছড়াছড়ি। এমন কোনও দোকান ছিল না, যেখানে প্ল্যাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার হতো না। হাট-বাজারে ঠোঙার চল উঠেই গিয়েছিল। শালপাতা তো দৈনন্দিন ব্যবহারের তালিকায় ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিল আগেই। অবাধে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহারের মাসুলও দিয়েছে শিলিগুড়ি।

২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ফি বর্ষায় জলমগ্ন হয়েছে শিলিগুড়ি। শহরের একাধিক উঁচু এলাকায় নর্দমার জল থমকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা ডুবিয়ে রেখেছে। সকাল থেকে দীর্ঘ সময় জলবন্দি থাকতে হয়েছে ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের।

পুরসভার একাধিক অফিসার-কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নালা-নর্দমায় জল থমকে যাওয়ার কারণ হল কেজি-কেজি প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ জমে যাওয়া। সেই ক্যারিব্যাগ সরাতে সাফাইকর্মীদের হিমসিম খেতে হয়েছে প্রতি বর্ষাতেই। শুধু তা-ই নয়, শহরের অন্যতম নদী মহানন্দায় সমীক্ষা করতে গিয়ে সে সময়েই পরিবেশবিদরা দেখেছেন, তলদেশে জমে রয়েছে টন-টন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ। নদীগর্ভ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। কারণ, একটা নির্দিষ্ট মাত্রার প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ জলে-মাটিতে মেশে না।

এমন একটা বিপদ মাথায় নিয়ে বসবাস করছিল শিলিগুড়ি। কিন্তু, তখনই নাগরিক সমাজের তরফে জোরালো আওয়াজ উঠল, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের হাত থেকে শহরকে বাঁচাতে হবে। সেই সময়ে শিলিগুড়িতে সবে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট বামেদের হটিয়ে শহরের দখল নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস বামেদের সমর্থনে বোর্ড গঠন করেছিল। এর পরে শহরবাসীর আর্জিতে সাড়া দিয়ে পুরসভা শহরকে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ মুক্ত করতে আসরে নামে। এক বছরের মধ্যে কী ভাবে শিলিগুড়ি প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ মুক্ত শহর হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছিল সে সব পরিবেশপ্রেমীদের সকলেরই জানা রয়েছে।

ঘটনা হল, শিলিগুড়ির সেই মর্যাদা, সম্মান, সম্ভ্রম এখন ধূলিসাত্‌ হওয়ার উপক্রম। শহরের নানা এলাকায় ফের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নির্মাতাদের একটি সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, নির্দিষ্ট মাত্রার প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করলে কোনও অসুবিধে নেই বলে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিয়েছে। এ কথা ঘোষণার পরে ফের শহরের আশেপাশে। শালুগাড়া থেকে ইস্টার্ন বাইপাসে ছোট-মাঝারি অনেক কারখানায় টন টন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ তৈরি হচ্ছে। প্লাস্টিক নির্মাতা সংস্থার অন্যতম কর্তা রতন বিহানির কথায়, “নির্দিষ্ট মাত্রার প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করলে পরিবেশের কোনও ক্ষতি হয় না। সে জন্য সর্বোচ্চ আদালতের গ্রিন বেঞ্চ শিলিগুড়িতে সব ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বন্ধের বিজ্ঞপ্তি আইনমাফিক হয়নি বলে মত প্রকাশ করেছে। ফলে, এখন নির্দিষ্ট মাত্রার প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহারে কোনও বাধা নেই।” শুধু তা-ই নয়, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি না করলে শিলিগুড়ি থেকে সব রকমের প্লািস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার বর্জন কখনও সম্ভব হবে না বলেও ব্যবসায়ীরা অনেকেই জানিয়ে দিয়েছেন।

তা হলে দার্জিলিং, সিকিমে কী ভাবে সব ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হল? সিকিম না হয় আলাদা রাজ্য। দার্জিলিং তো রাজ্যের মধ্যেই। তা হলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন সেই প্রশ্নও উঠেছে পরিবেশপ্রেমীদের মধ্যে। এমনকী, দ্রুত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করাতে কেন রাজ্য সরকার উদ্যোগী হচ্ছে না সেই প্রশ্নেও চলছে নানা আলোচনা। যদিও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব দাবি করেছেন, শহরে সব ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার যে পুরোপুরি বন্ধ হওয়া দরকার তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তা হলে?

(চলবে)

amar shohor kishore saha siliguri plastic carrybag
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy