Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মেয়েটা দেখল না, চোখে জল তাপসীর মায়ের

গাঢ় খয়েরি রঙের পাথরের মেয়ে-মূর্তিটা মুহূর্তে সবুজ! জনাকুড়ি গ্রামবাসী মুঠো মুঠো আবির ওড়াচ্ছিলেন। শাঁখ বাজছিল। তার নামে ঘনঘন স্লোগানও উঠছিল।

মেয়ের মূর্তির সামনে তাপসী মালিকের বাবা-মা। — নিজস্ব চিত্র।

মেয়ের মূর্তির সামনে তাপসী মালিকের বাবা-মা। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩১
Share: Save:

গাঢ় খয়েরি রঙের পাথরের মেয়ে-মূর্তিটা মুহূর্তে সবুজ! জনাকুড়ি গ্রামবাসী মুঠো মুঠো আবির ওড়াচ্ছিলেন। শাঁখ বাজছিল। তার নামে ঘনঘন স্লোগানও উঠছিল।

অনেকদিন পরে, বুধবার সিঙ্গুরের বাজেমিলিয়ায় সমবেত ভাবে তাপসী মালিকের নাম নিতে শোনা গেল গ্রামবাসীদের। তার নামে জয়ধ্বনিও উঠল।

সেই তাপসী, এখানকার জমি-আন্দোলনের মুখ। তৃণমূলের কথায় ‘শহিদ’! বুধবার সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পরে যার মা মলিনাদেবী জলভরা চোখে বলেই ফেললেন, ‘‘এই দিনটার জন্যই ১০ বছর অপেক্ষা করে ছিলাম। জয় সেই এল। শুধু মেয়েটা দেখতে পেল না।’’

২০০৬ থেকে ২০১৬— দশ বছরে সিঙ্গুরের জুলকিয়া খাল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। এমনকী, বাজেমিলিয়ায় মালিক-বাড়ির চেহারাটাও পাল্টে গিয়েছে আগাগোড়া। কিন্তু সিঙ্গুরের জমি-আন্দোলন এবং তাপসী মালিক— প্রায় সমার্থকই থেকে গিয়েছে।

দশ বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই মতো শুরু হয়ে গিয়েছিল জমি অধিগ্রহণও। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর ভোরে বাজেমিলিয়ায় টাটাদের প্রকল্প এলাকার জমিতে খোঁড়া একটি বড়সড় উনুনের ভিতর বছর ষোলোর তাপসীর অর্ধদগ্ধ দেহ দেখতে পান গ্রামবাসীরা। তখনও ধোঁয়া উঠছিল। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে। তাপসীর বাবা মনোরঞ্জনবাবু পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে জানান, তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। একই অভিযোগ তোলে তৃণমূলও। কারণ, তাপসী কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। সিপিএম অবশ্য সেই সময়ে তাপসীর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে।

পরে সিবিআই তাপসী-হত্যা মামলায় সিপিএমের সিঙ্গুর জোনাল কমিটির তৎকালীন সম্পাদক সুহৃদ দত্ত এবং তাঁর ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত দেবু মালিকে গ্রেফতার করে। বেশ কিছু দিন হাজতবাসের পরে দু’জনেই জামিন পান।

সেই মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু তাপসী-হত্যার ঘটনাকে হাতিয়ার করে রাজ্য জুড়ে জমি-আন্দোলনের মাত্রা বাড়ায় বিরোধী তৃণমূল। বাজেমিলিয়ায় তাপসীর বাড়ির সামনেই তার পাথরের মূর্তি বসানো হয়। সেই জমি-আন্দোলনই ২০১১ সালে বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে পৌঁছে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাপসীর নামে সিঙ্গুরে কিসান মান্ডি হয়। এ দিন রায় শোনার পরে নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেও উঠে আসে তাপসীর নাম।

গত কয়েক বছরে তাপসীদের মাটির বাড়ি পাকা হয়েছে। টালির চালের জায়গায় ছাদ হয়েছে। সিমেন্টের মেঝে ঢাকা পড়েছে মার্বেলে। তবু, এখনও মাঝেমধ্যে মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যান মলিনাদেবী। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা সিঙ্গুরে যে ‘কিসান-ভিশন’ প্রকল্প গড়েন, তাতে ঝুটো গয়নার দোকান করেন তাপসীর বাবা মনোরঞ্জনবাবু।

এ দিন তিনি বলেন, ‘‘মেয়ের জন্য দুঃখ হচ্ছে। আর জমি ফেরতের জন্য আনন্দ। আজকের দিনে ও থাকলে সবচেয়ে খুশি হতাম। তবে, আমি নিশ্চিত সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাপসীর আত্মা শান্তি পাবে।’’

তখনও বাজেমিলিয়ায় গ্রামবাসীদের মিছিলে শোনা যাচ্ছিল তাপসীর নাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Singur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE