Advertisement
E-Paper

নিয়োগে নীতির কাঁটা, আইন বাতিল চেয়েই কোর্টের রাস্তায়

পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশনের আইনের যুক্তি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এক জন আমলাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসালেও নৈতিকতার প্রশ্নটি তারা কোনও মতেই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন আইনজ্ঞ মহলের বড় অংশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫২

পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশনের আইনের যুক্তি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এক জন আমলাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসালেও নৈতিকতার প্রশ্নটি তারা কোনও মতেই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন আইনজ্ঞ মহলের বড় অংশ। তাঁদের মতে, সংবিধানের মূল দর্শনই হল নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে। কোনও পদস্থ আমলা, যিনি ভবিষ্যতে সরকারি কাজে ফিরে যাবেন, তাঁকে কমিশনের শীর্ষে বসালে সংবিধানের সেই দর্শনকেই উপেক্ষা করা হয়। অতএব এই ধরনের কোনও আইন থাকলে তা সংবিধানের ভাবধারার পরিপন্থী এবং অবিলম্বে তা খারিজ করা উচিত, এমনটাই মত ওই আইনজ্ঞদের।

এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন রাজ্যের বেশ কয়েক জন আইনজীবী। তাঁদের অভিযোগ, আইনের ফাঁকের সুযোগ নিয়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে বসিয়ে সরকার নৈতিকতা এবং সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছে। পাশাপাশি ১৯৯৪ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশন আইনের সংশোধনের আর্জিও আদালতের কাছে রাখবেন ওই আইনজীবীরা। কারণ, তাঁদের মতে, আইন সংশোধন না হলে ভবিষ্যতে ফের কোনও আমলাকে ওই পদে বসিয়ে কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হতে পারে। বৃহস্পতিবার ওই মামলা দায়ের করা হতে পারে জানিয়ে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ কোনও প্রবীণ আইনজীবী এই মামলা লড়বেন।

নৈতিকতার প্রশ্ন ঘিরে আইনজ্ঞ মহলের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলেও জলঘোলা শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন রাজ্যের একমাত্র বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। রাজ্য বিজেপি বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মামলা করার কথা ভাবছে সিপিএম-ও। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘নতুন কমিশনার যে ভাবে নিয়োগ করা হচ্ছে, তার সাংবিধানিক ও আইনগত বৈধতা আছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। দু’টো রাস্তা খোলা আছে। দরকার হলে আদালতে যাব। জনতার আদালতেও যাব।’’

দিল্লির আইনজীবী মহল বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যের আইনগুলি দুর্বল। তাতে বিস্তর ফাঁকফোকর থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কমিশন আইনটিও তেমনই। এবং এ রাজ্যই এর একমাত্র উদাহরণ নয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সলমন খুরশিদ বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশের আইনেও বলা হয়েছে, কর্তব্যরত কোনও আমলাকে তিন বছরের জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও কেউ এখনও এই আইনগুলিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেনি।’’ মামলা হলে আইনগুলি খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা যে প্রবল, সে কথা বলছেন প্রবীণ আইনজীবীরা।

অরুণাভবাবু বলেন, প্রশ্নটা নৈতিকতা এবং সাংবিধানিক নিরপেক্ষতার। কারণ, সংবিধানের ২৪৩ জেড-এ ধারা মতে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কারও নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারেন না। ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার রায়ে (কিষাণ সিংহ তোমার বনাম মিউনিসিপ্যাল কপোর্রেশন, গুজরাত) সংবিধানের ওই ধারাই বহাল রেখেছে‌।

আইনজ্ঞেরা বলছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের বসানোটাই রীতি। সাধারণত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব হিসেবে অবসর নেওয়া কোনও অফিসারকে নিয়োগ করা হয়। কারণ, চাকরির ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়ার আশা তাঁর থাকে না। রাজ্য তাঁকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। পাশাপাশি চাকরিতে সিনিয়র হওয়ার সুবাদে কমিশনের প্রয়োজনে রাজ্যের মুখ্যসচিবকেও তিনি তলব করতে পারেন। আইনজ্ঞদের মতে, অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও কোনও অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে নিয়োগ করার কথা বলা থাকলে নৈতিকতার প্রশ্নে সঠিক অবস্থান নেওয়া হতো।

কিন্তু রাজ্যের আইনে যা আছে, তাকে কাঁঠালের আমসত্ত্ব বলেই মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তাঁর মতে, আইনের এই সংস্থান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সিঙ্ঘভি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। অতীতে এ রকম কোনও নজিরও নেই। তা ছাড়া, নির্বাচন কমিশনার পদে ‘অ্যাড হক’ ভিত্তিতে নিয়োগ করা যায় না। আদালতে এই সিদ্ধান্তের বিচার হওয়া প্রয়োজন।’’ আইনজীবীদের অন্য একটি অংশ অবশ্য মনে করছেন, আইনের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজ্য সরকার বেআইনি কাজ করেছে, এ কথা বলা চলে না। হাইকোর্টের আইনজীবী নীলাঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইনের ৩ নম্বর ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী অসুস্থতা, মৃত্যু, ইস্তফা অথবা বিশেষ কোনও কারণে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ শূন্য হলে রাজ্যপাল কোনও কর্মরত সরকারি অফিসারকে সাময়িক ভাবে ওই পদে নিযুক্ত করবেন। স্থায়ী কমিশনার নিযুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজ চালাবেন। কোন পদমর্যাদার অফিসারকে অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার পদে বসানো হবে, ওই আইনে সেই বিষয়টির কোনও উল্লেখ নেই। ওই আইনটি সংশোধন না করা হলে রাজ্য সরকারের আর কিছু করার নেই।

জাতীয় নির্বাচন কমিশনের আইনি উপদেষ্টা মেন্দিরাত্তা এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপের মতে, ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশন রাজ্যের আইনে চলে। রাজ্যের আইনে যদি এ ধরনের নিয়োগের ব্যবস্থা থাকে, তা হলে এই নিয়োগ বৈধ। সাংবিধানিক বৈধতার দিকটি একমাত্র আদালতই খতিয়ে দেখতে পারে।’’

বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘আলাপনবাবুর নিয়োগে আইনি বাধা নেই। কিন্তু এই পুরভোটের নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এক জন কর্মরত আমলা এই পদে থেকে কতটা নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, সেটাও কিন্তু প্রশ্নাতীত নয়। এ সময়ে নিরপেক্ষ হিসেবে মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করাটাই মূল ব্যাপার।’’

বস্তুত, হাইকোর্টের মামলায় এই নিরপেক্ষতার প্রশ্নটাই তুলতে চলেছেন অরুণাভবাবুরা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও কর্মরত এক জন আমলা এবং তাঁর চাকরির পদোন্নতি, সরকারি সুবিধা পাওয়া, না পাওয়া সব কিছুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। তাই তাঁকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে নিযুক্ত করা হলে তাঁর কাছ থেকে কতখানি ‘নিরপেক্ষতা’ মিলবে, বা আদৌ মিলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।’’

অরুণাভবাবুদের যুক্তি হল, এমন একটা সময়ে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় পদত্যাগ করেছেন, যখন নানা অভিযোগে বিদ্ধ একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া মাঝপথে আটকে। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের এক একটি সিদ্ধান্ত রাজ্যের গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে হেতু আলাপনবাবুকে নিয়ন্ত্রণ করার দড়িটি এখন রাজ্য সরকারের হাতে, তাই অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কাজ করবেন না বলেই তাঁদের আশঙ্কা।

তাঁর নিয়োগের নৈতিকতা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার মধ্যে অবশ্য ঢুকতে চাইছেন না আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার একটি আইনানুগ আদেশনামা জারি করে আমাকে এই পদে নিয়োগ করেছে। সেই আদেশনামা অনুসরণ করে আমি এই পদে যোগ দিয়েছি। কোথায় কী আলোচনা হচ্ছে, আমি তার বিষয়বস্তু হতে পারি না।’’

alalpan bandyopadhyay opponent lawyers petition arunabha ghosh shamik bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy