Advertisement
০৩ মে ২০২৪

অনুব্রতের ঘনিষ্ঠ খুনে অভিযুক্ত বিরোধী গোষ্ঠীই

এক গোষ্ঠীর নেতা খুন হয়েছেন। তার পরপরই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কাউকে গুলি করে খুন করা হয়েছে! দু’বছর ধরে এ ভাবেই বীরভূমের দুবরাজপুর-খয়রাশোলে শাসক দলের দু’গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের খুন হতে দেখছেন এলাকাবাসী। শনিবার রাতে খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়কে গুলি করে খুন আদতে সেই বদলা-রাজনীতিরই জের কিনা, সেই জল্পনা উস্কে দিয়ে রবিবার রাতে অভিযোগ করা হল নিহত নেতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ৪৪ জনের বিরুদ্ধে।

অশোক মুখোপাধ্যায়ের গুলিবিদ্ধ দেহ কোলে নিয়ে বড় ছেলে সৌরভ। সিউড়ি হাসপাতালে। রবিবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

অশোক মুখোপাধ্যায়ের গুলিবিদ্ধ দেহ কোলে নিয়ে বড় ছেলে সৌরভ। সিউড়ি হাসপাতালে। রবিবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

দয়াল সেনগুপ্ত
খয়রাশোল শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪৬
Share: Save:

এক গোষ্ঠীর নেতা খুন হয়েছেন। তার পরপরই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কাউকে গুলি করে খুন করা হয়েছে!

দু’বছর ধরে এ ভাবেই বীরভূমের দুবরাজপুর-খয়রাশোলে শাসক দলের দু’গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের খুন হতে দেখছেন এলাকাবাসী। শনিবার রাতে খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়কে গুলি করে খুন আদতে সেই বদলা-রাজনীতিরই জের কিনা, সেই জল্পনা উস্কে দিয়ে রবিবার রাতে অভিযোগ করা হল নিহত নেতার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ৪৪ জনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন অশোক মুখোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ হিসাবে পরিচিত অশোক ঘোষের (যিনি নিজেও গত বছর গুলিতে খুন হন এবং অভিযোগ ওঠে অশোক মুখোপাধ্যায়ের দিকে) পরিবারের সদস্য। এক জন ভাই দীপক ঘোষ, অন্য জন ছেলে বিশ্বজিৎ। এ ছাড়াও নাম আছে অশোক ঘোষ ঘনিষ্ঠ অজিত ধীবর, শেখ জয়নাল, স্বপন সেন, যজ্ঞেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের এলাকার নেতাদের। পুলিশ কাউকে ধরেনি।

শনিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ পাঁচড়া গ্রামে নিজের বাড়ি থেকে শ’খানেক মিটার দূরে ফলের দোকানে গিয়েছিলেন খয়রাশোল ব্লকের প্রাক্তন তৃণমূল সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়। হঠাৎ দু’টি মোটরবাইকে চার জন এসে কয়েকটি গুলি ছুড়ে অশোকবাবুকে খুন করে পালায়। কিন্তু, এফআইআর করতে কেন ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল? নিহতের ভাই রজত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “আমাদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার পরেই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দাদার দেহের ময়নাতদন্ত ও শেষকৃত্য করতে সময় লেগেছে।” এফআইআর করেন নিহতের ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়।

ওই খুনের পর থেকেই এলাকা অশান্ত। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী যখন বারবার দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ, অবরোধের রাস্তা থেকে সরে আসার নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে উল্টো ঘটনাই এ দিন দেখা গেল খয়রাশোলে। অপরাধীদের ধরার দাবিতে অশোক মুখোপাধ্যায়ের দেহ আটকে রবিবার ভোর থেকে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পাচঁড়া মোড়ে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবোরধ করেন। দু’পাশে যানবাহন আটকে পড়ে। দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। প্রায় ৬ ঘণ্টা অবরোধ চলার পরে পুলিশ দেহটি ময়না-তদন্তের জন্য নিয়ে যায়।

বস্তুত, খয়রাশোলে অশোক ঘোষ (ইনিও প্রাক্তন ব্লক সভাপতি) এবং জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ অশোক মুখোপাধ্যায়ের গোষ্ঠীর বিবাদ দীর্ঘদিনের। এই বিবাদের আমলে দু’পক্ষের মোট ছয় নেতা খুন হয়েছেন। আততায়ীরা একই কায়দায় মোটরবাইকে এসে গুলি করে মেরে পালায়। দুই অশোকের খুনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর আগে দুই গোষ্ঠীর আরও চার নেতা খুন হন। অশোক ঘোষ খুনেও জেলায় অনুব্রত অনুগামী ও বিরোধীদের বিবাদ প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। নিহত নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অনুব্রত অশোক ঘোষের অনুগামী কর্মীদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। এ দিন অবশ্য নিহত নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী ছাড়া তৃণমূলের কোনও বড় নেতাকে দেখা যায়নি।

খয়রাশোল এলাকায় কোটি কোটি টাকার অবৈধ কয়লা কারবার থেকে পাওয়া তোলা এবং দু’টি খোলামুখ কয়লা খনির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মূলত দুই অশোক-গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব ছিল বলে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই। অশোক ঘোষকে সরিয়ে ব্লক সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়। তা নিয়ে দুই নেতার বিবাদ কখনও চাপা থাকেনি। অশোক ঘোষ খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়ই। ওই ঘটনার পরে দ্বিতীয় অশোক মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর গোষ্ঠীর অধিকাংশ নেতা-কর্মী গা ঢাকা দেন। তার পর থেকেই খয়রাশোলের নিয়ন্ত্রণ যায় নিহত অশোক ঘোষের ভাই দীপক ঘোষ-সহ কয়েক জনের হাতে। এখন খয়রাশোলে তৃণমূলের কোনও ব্লক সভাপতি নেই। ব্লক পরিচালনায় জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব পাঁচ সদস্যের কমিটি গড়েছেন। কমিটিতে ঘোষ-গোষ্ঠীর তিন ও মুখোপাধ্যায়-গোষ্ঠীর দুই সদস্য রয়েছেন।

অশোক মুখোপাধ্যায় খুনে কয়লা কারবারের যোগ থাকার ইঙ্গিত মিলেছে দলের জেলা সভাপতির বক্তব্যেও। যদিও তিনি কয়লা নিয়ে দলীয় দ্বন্দ্বের কথা মানেননি। অনুব্রতর দাবি, “এটা (খুনের ঘটনা) দলের মধ্যেকার কোনও ঘটনা নয়। এর পিছনে কয়লা মাফিয়ারা যুক্ত থাকতে পারে। পুলিশ তদন্ত করছে। আশা করছি, অপরাধীরা শীঘ্রই ধরা পড়বে।” এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় অবশ্য দলীয় কোন্দলের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেননি। তাঁর মন্তব্য, “দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরে এই খুন হয়েছে, তা বলছি না। আবার এমনটা যে হয়নি, তা-ও বলছি না।” অন্য দিকে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের জবাব, “একটা খুন হয়েছে। কোনও খুনই সমর্থনযোগ্য নয়। পুলিশ তদন্ত করছে। দোষীরা শাস্তি পাবে। এ ছাড়া কী বলব? আমি শার্লক হোমস বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নই! ফলে দোষী খুঁজে বার করা আমার কাজ নয়।”

দীপক ঘোষের (অশোক মুখোপাধ্যায় খুনে অভিযুক্ত এবং ব্লক কমিটির পাঁচ সদস্যের অন্যতম) দাবি, “আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে অভিযোগ করা হয়েছে। এই খুনের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগ নেই।” অশোক ঘোষের পুরনো এক অনুগামী বলেন, “ব্লকের রাশ এখন আমাদেরই হাতে। তাই এ রকম কিছ ঘটালে আমাদের লোকেরাই যে মামলায় ফাঁসবে, সে বুদ্ধি আমাদের রয়েছে। আমরা খামোকা নিজেদের জায়গা দুর্বল করতে যাব কেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE