হওয়ারই ছিল। এ দেশে সফ্টওয়্যার বহুজাতিক ওর্যাকল-এর ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনায় রাজ্যের ঠাঁই না পাওয়াকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছে শিল্পমহল।
তাদের বক্তব্য, তৃণমূল সরকার গোড়া থেকেই বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (সেজ) বিরোধী। তার জেরে ইনফোসিস-উইপ্রোকে জমি দেওয়া ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি হাব রাজারহাটে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। আর সার্বিক ভাবে লগ্নি টানা এবং তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে রাজ্যের মলিন ভাবমূর্তি। এই সব কিছুর খেসারত দিতে গিয়ে ক্রমেই লম্বা হচ্ছে খোয়ানোর তালিকা। যাতে নবতম সংযোজন ওর্যাকল।
বহু শিল্পকর্তাই বলছেন, এ বারও বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী গালভরা লগ্নি-প্রস্তাবের অঙ্ক ঘোষণা করেছেন ঠিকই। কিন্তু ওর্যাকলের মুখ ফিরিয়ে থাকাই রাজ্যে শিল্পের আসল ছবি। এই ‘কঙ্কাল’ও বেরিয়ে আসছে যে, এক সময়ের গর্বের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে এখন পশ্চিমবঙ্গকে টপকে যাচ্ছে অনেক পরে দৌড় শুরু করা রাজ্যগুলি। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই অনেক দিনই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কলকাতাকে এখন হেলায় টপকে যাচ্ছে তিরুঅনন্তপুরম, বিশাখাপত্তনম, কোচি, বিজয়ওয়াড়ার মতো শহরও।
ভারতে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৪০ কোটি ডলার (২,৭২০ কোটি টাকা) বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে ওর্যাকল। চেন্নাই, গুড়গাঁও, নয়ডা, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, হায়দরাবাদ, পুণে, তিরুঅনন্তপুরম ও বিজয়ওয়াড়ায় তৈরি হচ্ছে তাদের গবেষণা ও উদ্ভাবনী কেন্দ্র (ইনকিউবেশন সেন্টার)। টাকার অঙ্কে হয়তো এই লগ্নি বড় নয়। কিন্তু মেধার টানে সফটওয়্যার ব্যবসার আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞা করা রাজ্যের তালিকা থেকে ছিটকে যাওয়াও যথেষ্ট প্রতীকী।
গুগ্ল, মাইক্রোসফট, ওর্যাকলের মতো তথ্যপ্রযুক্তি দৈত্যদের ক্যাম্পাস এ রাজ্যে নেই। ক্ষুব্ধ শিল্পমহলের দাবি, যে রাজ্যে স্রেফ সেজ নিয়ে ছুতমার্গের কারণে ইনফোসিস জমি পায় না, জমি-জটে বিদায় নেয় ন্যানো, সেখানে লগ্নি আসবে কোথা থেকে? বণিকসভার এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘যে রাজ্যে রতন টাটাকে পাগল বলে অসম্মান করা হয়, সেখানে লগ্নিকারী পা রাখবেন কোন সাহসে?’’
তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ টানায় সেজ নিয়ে ছুঁতমার্গ যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা স্পষ্ট পরিসংখ্যানেও। ২০১৩-’১৪ সালে কেরল থেকে সফটওয়্যার রফতানির পরিমাণ ছিল ৭,০০০ কোটি টাকা। প্রায় ৪৩% বেড়ে ২০১৪-’১৫ সালে তা পৌঁছেছে ১০,০০০ কোটিতে। সেখানে ওই একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সফটওয়্যার রফতানি বেড়েছে মাত্র ১১%। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের দাবি, এই ফারাকের মূলে রয়েছে সেজ। কেরলে তৈরি হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্ সেজ—টেকনোপার্ক। ইনফোসিস, টিসিএস, এজিস থেকে শুরু করে ওর্যাকলের মতো সংস্থা ব্যবসা করছে সেখানে। কেরলের সফটওয়্যার রফতানির ৬০ শতাংশই হচ্ছে ওই সেজ থেকে। সেখানে গত পাঁচ বছরে সেজ-এর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে বাড়েনি। বাম আমলে যা ছিল, এখনও তা-ই।
বামেদের দাবি, তথ্যপ্রযুক্তিতে লগ্নি টানার জন্য তাঁরা সঠিক নীতি নিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের সঙ্গে। প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমি আমার সচিবকে নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার দরজায় বেচুবাবুর মতো বসে থাকতাম।’’ সেই চেষ্টার জেরেই দেশের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি সেজ গড়ে উঠেছিল এ রাজ্যে। উইপ্রোর হাত ধরে। কিন্তু গত চার বছরে সরকারের উদ্যোগটাই হারিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ মানববাবুর। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমি নিয়ে জেদ। মুখ্যমন্ত্রী সেজ-বিরোধী। তাই ঝুলে রয়েছে উইপ্রোর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। আটকে ইনফোসিসের লগ্নি। জমি অধিগ্রহণে সরকারের আপত্তিও লগ্নির পথে বড় বাধা। শিল্পমহল বারবার বলেছে অসংখ্য মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি করে জমি কেনা অসম্ভব। কিন্তু সরকারের অবস্থান বদলায়নি।
তার উপর সিন্ডিকেটের দাপট এবং তোলাবাজিরও দিন দিন বাড়ছে। ২০১২ সালে রাজারহাটে তোলাবাজদের অত্যাচারে জেরবার কয়েকটি সংস্থা তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়ে সমস্যা জানিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ক্যাপজেমিনি, জেনপ্যাক্ট, টিসিএস, কগনিজ্যান্ট ইত্যাদি। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। এর পরেও টিসিএস ১,৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্পে সাফাই কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান-সহ বিভিন্ন কর্মী নিয়োগে সমস্যায় পড়েছে। তোলাবাজির শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি-ও।
এ সবের জেরে লগ্নি যে আরও শুকিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট অফিসের জন্য জায়গা (অফিস স্পেস) নেওয়ার অনীহায়। উপদেষ্টা সংস্থা জোনস লাং ল্যাসেলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে ৩৫ কোটি বর্গ ফুট অফিস-স্পেস নিয়েছে কপোর্রেট। ২০১৪ সালের চেয়ে ১৭% বেশি। ব্যতিক্রম কলকাতা। সেখানে চাহিদা কমেছে ৩০%। একই রকম মলিন ই-কমার্স ও স্টার্ট-আপের ছবিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy