Advertisement
১৭ মে ২০২৪

শিয়রে সিন্ডিকেট, ছাদ নড়বড়ে গেরস্তেরও

শুধু সেতু বা রাস্তা নয়। নিচু মানের নির্মাণের কারণে মধ্যবিত্তের মাথার ছাদও যখন-তখন হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়তে পারে, যদি না সিন্ডিকেটের জুলুমবাজিতে অবিলম্বে রাশ টানা হয়। অন্তত রাজ্যের আবাসন শিল্পমহলের তা-ই অভিমত।

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৯
Share: Save:

শুধু সেতু বা রাস্তা নয়। নিচু মানের নির্মাণের কারণে মধ্যবিত্তের মাথার ছাদও যখন-তখন হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়তে পারে, যদি না সিন্ডিকেটের জুলুমবাজিতে অবিলম্বে রাশ টানা হয়। অন্তত রাজ্যের আবাসন শিল্পমহলের তা-ই অভিমত।

এবং এর সমর্থনে ভুরি ভুরি উদাহরণও উঠে আসছে। অভিযোগ: রাজারহাট থেকে ইএম বাইপাস, বেহালা থেকে বারুইপুর— সর্বত্র ইমারতি শিল্পের ঘাড়ে চেপে বসেছে সিন্ডিকেট। যার পেট ভরাতে গিয়ে নির্মাতার মুনাফা তো মার খাচ্ছেই, বাড়ির গুণগত মানও গোল্লায় যাচ্ছে।

পরিণামে নিরাপত্তার মস্ত

ঝুঁকি নিয়ে নতুন বাড়িতে ঢুকছেন ক্রেতারা। নির্মাণসংস্থা সংগঠন ‘ক্রেডাই’-এর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘দাদাগিরি’র চাপে সিন্ডিকেটের থেকে চড়া দামে ইট-বালি কিনতে বাধ্য হওয়ায় নির্মাণ-খরচ বাড়ছে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম না-বাড়িয়ে উপায় থাকছে না। ‘‘সেটা সম্ভব না-হলেই বিপদ। তখন মুনাফা ঠিক রাখতে মালমশলার মান ও পরিমাণ, দুয়েতেই টান পড়ছে। যেখানে যতটা বালি-সিমেন্ট বা স্টোন চিপ্‌স দরকার, দেওয়া হচ্ছে না। যা দেওয়া হচ্ছে, তার মানও হয়তো কহতব্য নয়।’’— বলছেন ওই বিল্ডার।

অর্থাৎ পরোক্ষে সিন্ডিকেটবাজির শিকার হচ্ছেন সাধারণ বহু মধ্যবিত্ত- নিম্ন মধ্যবিত্ত, যাঁরা কিনা সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করেছেন। অথচ ক’দিন বাদেই তাঁদের ‘স্বপ্ন নীড়’ ভেঙে-চুরে খানখান! নতুন ফ্ল্যাটের দেওয়ালে ফাটল, জল চুঁইয়ে পড়ছে, ছাদের চাঙড় খসে পড়ার জোগাড়। ক্রেডাই-সূত্রের খবর: ছোট নির্মাতাদের

সমস্যা আরও বেশি। তাদের স্বল্প বিনিয়োগের প্রকল্পে লাভের অঙ্ক কম। তার গুড়ও সিন্ডিকেট খেয়ে যাওয়ায় অনেকে মরিয়া হয়ে উঠছেন।

‘‘ব্যয় সঙ্কোচের তাগিদে তখন অনেক ক্ষেত্রে চুন-বালি-ইট-সুরকির মতো বুনিয়াদি কাঁচামাল এতই খারাপ মাপে দেওয়া হচ্ছে যে, দু’তিন বছরের মধ্যে নতুন ফ্ল্যাটের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ছে।’’— আক্ষেপ এক ডেভেলপারের। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘নির্মাণে গলদ থাকায় শিবালিক ভেঙে পড়েছিল। এ ভাবে চলতে থাকলে আরও অনেক শিবালিক ঘটবে। তার দায় কে নেবে?’’

সাতাশ বছর আগে ভবানীপুরের নতুন বহুতল ‘শিবালিক’ ধূলিসাৎ হয়ে ১১ জনের প্রাণ গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার পোস্তায় নির্মীয়মাণ বিবেকানন্দ উড়ালপুলের একাংশ ধসে অন্তত ২৪ জন মারা গিয়েছেন। এই বিপর্যয়ের পিছনেও নিচু মানের নির্মাণের ভূমিকা থাকতে পারে বলে কিছু মহলের আশঙ্কা।

এ হেন প্রেক্ষাপটেই সিন্ডিকেট-রাজ ঘিরে আশঙ্কা আবার প্রকট হয়ে উঠেছে নির্মাতা মহলে। তাদের অভিযোগ: ইট-বালি হোক বা স্টোন চিপ্‌স— সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সব কিছুই বাজারদরের বিস্তর বেশি দামে কিনতে হয়। জিনিসগুলোর গুণগত মানও হামেশা ঠিক থাকে না। নমুনা হিসেবে দক্ষিণ শহরতলির প্রোমোটার বলছেন, ‘‘গ্রেড টু বলে যে ইট ওরা আমাদের বেচছে, তা আসলে নিম্নমানের গ্রেড থ্রি। এক পিসের দাম বড়জোর সাত-আট টাকা। কিনতে হচ্ছে দশ টাকায়।’’

জেনে-শুনে কিনছেন কেন?

নিউটাউনের এক প্রোমোটার শোনালেন নিজের অভিজ্ঞতা।

বেশি দামে খারাপ মাল কিনতে তিনি রাজি হননি। পরিণামে পরের প্রকল্পের ছাড়পত্র পেতে কালঘাম ছুটেছে। ‘‘সিন্ডিকেটের হাত যে কত লম্বা, তার আন্দাজ থাকলে এমন প্রশ্ন করতেন না।’’— ক্ষোভ ঝরে পড়ে তাঁর গলায়।

বস্তুত রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সিন্ডিকেট-রাজের ‘সহাবস্থান’ ও পারস্পরিক সহায়তা নিয়ে অভিযোগ কম নয়। ক্ষমতার অঙ্ক কষে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশও সিন্ডিকেটের চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ মজুত। প্রতিকার কার্যত নেই। ফলে নির্মাতারাও ‘সার সত্য’ সমঝে গিয়েছেন। এমনকী, সিন্ডিকেট চার হাজার ইট বেচলে আদতে যে সাড়ে তিন হাজার পাওয়া যাবে, সেই ‘দস্তুর’ও মেনে নিতে হচ্ছে!

সিন্ডিকেটের হুজ্জতি এড়াতে কিছু সংস্থা ‘রেডি মিক্সের’ কথা ভেবেছে। মানে পাথরকুচি, বালি ইত্যাদি মেশানো যে কাঁচামাল। তবে দাম বেশি বলে অনেক নির্মাতার পক্ষে

তা কেনা সম্ভব হয় না। উপরন্তু বেশি দাম দিতে চাইলেও কোথাও কোথাও কেনা যায় না সিন্ডিকেটেরই বাধায়। সম্প্রতি যেমন রাজারহাটের এক প্রকল্পে রেডি মিক্সের গাড়ি আটকে দিয়েছিল সিন্ডিকেটের ছেলেরা। অভিযোগ, মারধর খেয়ে চালক গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যায়। পরে সংস্থাটি সিন্ডিকেটের থেকেই ইমারতি দ্রব্য কিনতে বাধ্য হয়েছে।

অর্থাৎ, কোনও পথেই ছুটকারা নেই। ক্রেডাই-সূত্রের খবর: লাভের টাকা এ ভাবে সিন্ডিকেটের পকেটে গুঁজতে গুঁজতে বহু ছোট নির্মাতার নাভিশ্বাস উঠেছে। কিছু সংস্থা ব্যবসা গুটিয়ে দিয়েছে। আর একটা বড় অংশ হাঁটছে নির্মাণের মান নিয়ে আপসের রাস্তায়। সামর্থ্য আছে যাদের, তারা বাঁচতে চাইছে নানা কৌশলে। যেমন, আইটিসি ইনফোটেক। রাজারহাটে প্রায় ১৭ একর জুড়ে তৈরি হবে তাদের প্রকল্প। কিন্তু ক্যাম্পাসের পাঁচিল তৈরির দায়িত্ব তারা সঁপেছে হিডকো’র হাতে, যাতে ‘দাদাগিরি’র প্রাথমিক ধাক্কাটা অন্তত এড়ানো যায়।

কিন্তু সাধারণ গৃহস্থের তো সে ক্ষমতা নেই! তাঁদের ছোটখোটো ফ্ল্যাট-বাড়ি বানাচ্ছে যারা, সেই ছোট-মাঝারি বিল্ডারদেরও নেই তেমন কোনও রক্ষাকবচ। প্রসঙ্গত, সিন্ডিকেটবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে এক বার তাবড় আইটি কোম্পানিগুলো মিলে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল। রাজ্যের তদানীন্তন শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘‘কড়া ব্যবস্থা’র আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবু সিন্ডিকেটের দাপট বাড়তে বা়ড়তে তুঙ্গে উঠেছে।

জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে কেনা বাড়িতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করা ছাড়া আম গেরস্তের উপায় কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE