বছর আটেকের ‘পাকাবুড়ি’র রিনরিনে স্বর শুনে কেমন যেন থ’ হয়ে গিয়েছিলেন মা-বাবা!
ছোট্ট মেঘাভিনী থেমে থেমে বলেছিল, ‘‘তোমাদের টাকা চলবে না? আমারগুলো চলবে কি না দেখো তো?’’
বলে কী পুচকিটা! মেয়ের প্রাণের ‘পিগি-ব্যাঙ্ক’-এর তালা খুলতে তখনও বুকে বাজছিল আইটি পেশাদার অলোক মিত্রের। কিন্তু নাকতলার তরুণ গৃহকর্তার তত দিনে নাগাড়ে ব্যাঙ্ক-অফিস-এটিএম-বাজার সামলাতে সামলাতে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ দশা। প্রধানমন্ত্রীর নোট-ফতোয়া ঘোষণার দিন পাঁচেক বাদেও কোথাও চালাতে না-পারা পাঁচশো-হাজারের খান ছয়েক নোট যেন ঠাট্টা করছে জেরবার গেরস্থকে। দরকারি ওযুধ কেনা হচ্ছে না। ও-বেলা কী রান্না হবে তার ঠিক নেই। রিটেল শপে যাবেন, না মুদির দোকানে বাকিতে চালিয়ে নেবেন, ভাবতে ভাবতেই অদ্ভুত ভাবে বেরোল মুশকিল আসান। সারা ক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখা আদরের কন্যেই যে নোট-ত্রাতা হবে, তা ভাবেননি বাবা।
এবং সেটাই ঘটল। মেঘাভিনীর গোলাপি ‘পিগি-ব্যাঙ্ক’খানা ঝেড়েঝুড়ে মালুম হল, খুচরো পয়সা, দশ-বিশ-পঞ্চাশের সঙ্গে ১০০-র নোটও ক’খানা মজুত। মামা-মাসি-কাকু-দাদুদের থেকে মেলা-পার্বণী, বিকেলে টুকটাক চিপ্স-চকোলেট চাখার খরচ বাঁচিয়ে বিচক্ষণ খুদে বেশ কয়েকশো জমিয়েছে তার নিজস্ব ‘ব্যাঙ্কে’! অসহায় মা-বাপের কাছে সেটাই মহার্ঘ সম্পদ। সপ্তাহের ঘর-গেরস্থালির বড় খরচ ওই টাকাতেই সামলানো গেল। মেয়েকে চুমু খেয়ে বাবা বলেন, ‘‘বাঁচালি, তুই! কথা দিচ্ছি, পরের মাসেই তোর পছন্দের পুতুল এনে দেব।’’
বাগুইআটির চয়িতা ঘোষ ও সুমন নাথ আবার মেয়ের অনুমতির জন্যও অপেক্ষা করতে পারেননি। পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল ঘোষণার সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রীর সম্বল বলতে ছিল সাকুল্যে খান তিনেক একশোর নোট। দিন দুয়েক ব্যাঙ্ক আর এটিএমে তেড়েফুঁড়ে যুদ্ধের পর ধস্ত দশায় দু’জনেই রণে ভঙ্গ দিলেন। এর পরে বাধ্য হয়েই কন্যারত্ন চার বছরের সমৃদ্ধির সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। মেয়ে ঘুমোনোর পরে চুপিচুপি তার ‘পিগি-ব্যাঙ্ক’ ঘেঁটে মিলেছে, সতেরোশো টাকা! চয়িতা বললেন, ‘‘অত খুচরো তো চট করে ফেরাতে পারব না, তবে ‘চুরি’ করা টাকা মেয়েকে পরের মাসে পাক্কা ফিরিয়ে দেব। আপাতত এ ছাড়া বাজার করার উপায় ছিল না।’’ সুমনের কৌতুক-টিপ্পনী, ‘‘মনে হচ্ছে ঘরে অনেক খুদে থাকলে ভাল হতো। আরও কয়েকশো নগদ মিলত।’’
নোট-নাকাল ঘরে ঘরে সংসার চালানোর হাতিয়ার হিসেবে এ ভাবেই বড় ভরসা হয়ে উঠেছে শিশুর সঞ্চয়। টানাটানির সংসারে বরের পকেট ঝেড়ে জমানো গিন্নিদের সম্পত্তি কী ভাবে ঘোর দুর্দিনে পরিবারকে নানা সঙ্কটে উদ্ধার করেছে, তার ভুরি ভুরি ফিরিস্তি মিলবে। দেখা যাচ্ছে, রোজগেরে মা-বাপের সংসারে আজকের নিউক্লিয়ার পরিবারেও খুদেদের জমানো টাকা কম দামি নয়। সাবেক লক্ষ্মীর ভাঁড়ের জায়গা নিয়েছে, ঝকঝকে রঙিন মজাদার শুয়োর বা পেটমোটা মাছের আধার। কোনওটায় আবার ডগ হাউসের আদল। নির্দিষ্ট জায়গায় কয়েন রাখলে ভেতর থেকে কুকুরছানা বেরিয়ে এসে তা ফেলে দেয় ব্যাঙ্কের পেটে। নোট-খুচরোয় ভরে উঠলে না-ভেঙেই খুলে ফেলা যায় এ সব পিগি ব্যাঙ্ক। নোট-আকালের দিনকালে বাচ্চাদের টাকা জমানোর ওই ‘ব্যাঙ্ক’গুলোই অনেক ক্ষেত্রে সংসারের চাকা সচল রাখছে।
ঠিক বাচ্চাদের গোত্রে পড়বেন না, এমন ‘ছোট’রাও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকায়। ডানলপের মনীষা নস্কর! রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্স ফাইনাল ইয়ারও মা-বাবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। খুচরো ঝনঝন ‘পিগি-ব্যাঙ্ক’টা উঁচিয়ে ধরে মাকে বলেছেন, ‘‘কী, খুব যে কিপটে বলে ঠেস দিতে, এখন চাইলে এই ব্যাঙ্কই তোমাদের ধার দেবে।’’
ছোট থেকে জমানো টাকার ভাগ থেকে দশটা একশোর নোট বার করে জলজ্যান্ত এটিএমের মতো মা-বাবার সামনে মেলে ধরেছেন মেয়ে। তবে বাবা মদন নস্করের হাতে এই সম্পদ তুলে দেওয়ার আগে মজা করে মনীষা বলতে ছা়ড়েননি, ‘‘ফেরতের সময়ে একটু সুদ দিতেও ভুলো না কিন্তু।’’
আকাশের চাঁদ পাওয়ার ভঙ্গিতেই কৃতজ্ঞচিত্তে মেয়ের দান গ্রহণ করেছেন বাবা। তার কাঁধে হাতটা রেখে মন্তব্য, ‘‘ভাগ্যে খুকি ছিল আমার কাছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy