বাঘ-সিংহ-হাতি থেকে ময়ূর-ম্যাকাও পর্যন্ত চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের দত্তক নেওয়ার বন্দোবস্ত আছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার গাছ দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
তফাত এই যে, ইচ্ছুকেরাই শুধু পশু বা পাখি দত্তক নিতে পারেন। আর গাছশিশু দত্তক দেওয়া হবে সেই সব পরিবারেই, যেখানে নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে বা হবে। নবজাতক আর চারাগাছ বেড়ে উঠবে একই সঙ্গে। পার্থক্য আরও একটু আছে। দত্তক নেওয়া পশুপাখি চিড়িয়াখানাতেই থাকে। তবে দত্তক গাছ নিজেদের জমিতে লাগিয়ে লালনপালন করতে পারবে নবজাতকের পরিবার। তা ছাড়া দত্তক নিলেই পশু বা পাখির মালিকানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার উপরে বর্তায় না। কিন্তু দত্তক নেওয়া গাছের মালিকানা পাবে সদ্যোজাত শিশুর পরিবার। আর সেখানেই আছে মমতার এই প্রকল্পের ব্যাখ্যা।
মুখ্যমন্ত্রী গাছ দত্তক দেওয়ার এই প্রকল্পের নাম রেখেছেন ‘সবুজশ্রী’। উদ্দেশ্য তিনটি। নবান্নের এক কর্তা জানান: • শিশুর জন্ম হলেই সংশ্লিষ্ট পরিবারের হাতে একটি গাছ দত্তক দেওয়া হবে। তাতে এক দিকে হবে সবুজায়ন। বাঁচবে পরিবেশ। • সেই গাছ পরিণত হলে তাকে বিক্রি করে সন্তানের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও সুরক্ষিত করা যাবে। অর্থাৎ বাঁচবে ভাবী প্রজন্ম। • সেই সঙ্গে বাড়ানো যাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব। গ্রামবাংলায় এখনও হাসপাতাল বা প্রসূতিসদনে না-পাঠিয়ে বাড়িতেই প্রসবের প্রবণতা বেশি। তাতে ঝুঁকিও যে বেশি, সেই বিষয়ে প্রচার চালিয়েও সকলকে সচেতন করা যাচ্ছে না। গাছ দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থায় আয়ের নিশ্চয়তা থাকায় প্রসূতিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পাঠানোর তাগিদ বাড়বে। কেননা, শিশু জন্মের তথ্য সরকারি নথিতে উঠলে তবেই দত্তক দেওয়া হবে চারাগাছ। প্রসব সংক্রান্ত তথ্যে কোনও গোলমাল থাকলে গাছ দেওয়ার সময়েই সেটা ধরা পড়ে যাবে। কারণ, সদ্যোজাতদের হিসেব নেওয়া হবে স্বাস্থ্য দফতর থেকে।
‘‘নবজাতকের নামে পরিবারকে একটি করে অর্থকরী গাছের চারা দত্তক দেবে সরকার। শিশুটির নামেই গাছটিকে বড় করে তুলবে তার পরিবার। ২০-২৫ বছর পরে সেই গাছ বিক্রি করে যে-টাকা পাওয়া যাবে, সেটাই তখন সাবালক হয়ে ওঠা সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কাজে লাগবে,’’ বললেন ওই নবান্ন-কর্তা।
সম্প্রতি জেলা সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে-তিনটি নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘সবুজশ্রী’ তারই অন্যতম। অন্য দু’টি প্রকল্প হল ‘সমব্যথী’ ও ‘বৈতরণী’। তিনটি প্রকল্পের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করে ফেলেছে নবান্ন। বন দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্যে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লক্ষ শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। ঠিক হয়েছে, প্রকল্প শুরুর প্রথম তিন বছর শিশুদের পরিবারের কাছে পুরনো গাছের চারা পৌঁছে দেওয়া হবে। পুরনো চারা হওয়ায় তা বছরের যে-কোনও সময়েই লাগানো যাবে। প্রশ্ন উঠছে, কোনও পরিবারের হাতে যদি গাছ লাগানোর মতো আদৌ জায়গাই না-থাকে, তা হলে কী হবে?
বনকর্তারা জানাচ্ছেন, এই ধরনের পরিবারের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করে দেবে পঞ্চায়েত ও পুরসভা। দু’-আড়াই দশক পরে সেই গাছ কাটার অধিকার পাবে সংশ্লিষ্ট পরিবার। এক বনকর্তা জানান, আপাতত বন দফতর গাছ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেও ধাপে ধাপে সেই দায়িত্ব পঞ্চায়েত ও পুরসভার হাতে তুলে দেওয়া হবে। প্রকল্পের যাবতীয় খরচ সরকারের।
সবুজশ্রী যদি নবজাতকের কল্যাণ-প্রকল্প হয়, গরিব পরিবারের প্রয়াত ব্যক্তির পারানির কড়ি জোগানোর ব্যবস্থা হচ্ছে ‘সমব্যথী’ প্রকল্পে। হতদরিদ্র পরিবারের কেউ মারা গেলে তাঁর সৎকারের জন্য এই প্রকল্পে সরকারি অনুদান মিলবে। নবান্নের এক কর্তা জানান, এই প্রকল্পে মৃতদেহ সৎকারের জন্য দু’হাজার টাকা অনুদান দেবে সরকার। এই প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। এর মধ্যে প্রথম বছরে খরচ ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এক নবান্ন-কর্তা বলেন, ‘‘এ রাজ্যে বছরে গড়ে ছ’লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তার এক-তৃতীয়াংশ এই প্রকল্পের আওতায় এলেই তাঁদের অন্ত্যেষ্টিতে ৪০ কোটি টাকার
প্রয়োজন হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত তৃতীয় প্রকল্পটি হল ‘বৈতরণী’। এই প্রকল্পে রাজ্যের সব শ্মশান পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা এবং সৎকারস্থল বাঁধিয়ে মাথায় ছাউনি বানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রয়েছে প্রতিটি শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানোর পরিকল্পনাও। এই সব পরিকল্পনা রূপায়ণে সব ব্লকে শ্মশান-শুমারি চালানোর জন্য ভূমি দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট এলে প্রথম দফায় সৎকারস্থল বাঁধিয়ে ছাউনি তৈরি করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা হবে একটি নলকূপ এবং শৌচাগারেরও। পরের দফায় পাঁচিল এবং বৈদ্যুতিক চুল্লির প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy