প্রতীকী ছবি।
দুর্গাপুজো উপলক্ষে মুম্বইয়ে এক অনুষ্ঠানে এক বার এক নামী শিল্পী গাইতে উঠেছেন। অনুষ্ঠানের আয়োজকও স্বনামধন্য এক গায়ক। কিন্তু কলকাতার ওই গায়িকা একটা গান গাওয়ার পরে দ্বিতীয় গানের মাঝপথেই মাইক বন্ধ করে দিল পুলিশ। কারণ, তখন রাত ১০টা বেজে গিয়েছে।
এ বার শব্দদূষণ নিয়ে যখন ত্রাহি ত্রাহি রব চতুর্দিকে, সেই আবহে কলকাতায় এমনটা কবে হবে বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা কিছুটা ভুল করছেন। আসলে এই শহরেও এহেন নজির আছে। একটু ভুল হল। ছিল।
গড়িয়াহাট তল্লাটে এক বারোয়ারি পুজোর উদ্যোক্তাদের বিজয়া সম্মিলনী। একটি বাংলা ব্যান্ড সবে দু’টো গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছে। শ্রোতারা চাগছেন। কিন্তু তার পরেই মাইক বন্ধ। ঘড়ির কাঁটা মাইক বাজানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা, মানে রাত ১০টা পেরিয়ে গিয়েছে।
আসলে সেটা ছিল পর্ষদের সক্রিয়তার যুগ। এবং পুলিশেরও।
শব্দদৈত্যকে বোতলবন্দি করতে হবে, এমন একটা জেদ ছিল তখন। তার পর সেই তাগিদটা হঠাৎ উধাও!
বেলেঘাটায় ইএম বাইপাস লাগোয়া বহুতলের এক বাসিন্দাকে শব্দবাজি ফাটানোর সময়ে কৌশলে হাতেনাতে ধরেছিলেন স্থানীয় থানার ওসি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লালবাজারের এক প্রভাবশালী কর্তা ফোন করে রীতিমতো হুমকির সুরে বললেন, ‘কী পেয়েছেনটা কী আপনি? একটু বাজি ফাটিয়েছে বলে আপনি গ্রেফতার করবেন? এমনিতে তো চোর-ডাকাত ধরতে পারেন না।’ পরে জানা গিয়েছিল, ওই পুলিশকর্তা আর ধৃত ব্যক্তি স্কুলতুতো বন্ধু।
ওই ঘটনা সাত বছর আগে কালীপুজোর রাতের। শব্দবাজি নিয়ে পুলিশের একাংশের মানসিকতা কী রকম, ওই ঘটনা তার উদাহরণ। শব্দবাজির ব্যবহার, রাত ১০টার পর মাইক বাজানো, হাসপাতাল চত্বরে মাইকের শব্দ, বিসর্জনের মিছিলে ‘ডিজে’-র দাপট যে আইনত নিষিদ্ধ, সেটা বহু পুলিশের জানা নেই। সামনে বাজি ফাটলেও বহু পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ওই সব পুলিশ অফিসার ও কর্মী জানেন না যে, চোর-ডাকাতের মতো দূষণ ঘটানো লোককেও গ্রেফতার করা যায়। হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশ যে ‘সাইলেন্স জোন’-এর আওতায়, সেটাও তাঁদের জানা নেই। আবার যে সব পুলিশ অফিসার ওয়াকিবহাল, তাঁদের অনেকের কাছে এটা ‘সামান্য ঘটনা’ বা শাস্তিযোগ্য অপরাধই নয়। বেলেঘাটার ঘটনায় লালবাজারের সেই কর্তার মতো। যার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বেলেঘাটার ঘটনা যে সময়ের, তখন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নজরদারি দল বেরোত। কলকাতা ও সল্টলেকে ছ’টা, জেলায় আরও আটটা। মানে, পুলিশকে ঠেলে কাজ করানোর জন্য পর্ষদ ছিল। বেলেঘাটার ওসি ইএম বাইপাস লাগোয়া বহুতলে বাজি ফাটার খবর পেয়েছিলেন পর্ষদের নজরদারি দলের কাছ থেকেই। ২০১২ থেকে পর্ষদের নজরদারি বন্ধ।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘পাঁচ-ছ’বছর আগেও পর্ষদের কাছ থেকে আমরা মুহুর্মুহু ফোন পেতাম। কালীপুজো তো বটেই, বিশ্বকর্মা পুজো, দুর্গাপুজোর বিসর্জন আর লক্ষ্মীপুজোয়। আমাদের সব সময়ে তটস্থ থাকতে হত। এখন সে সব ফোন আসে না।’’
পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বরাবর যুক্তি দেন, ‘‘পুলিশকে আমাদের বলতে হবে কেন? ওঁরা তো নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারেন।’’
ঘটনা। কিন্তু পর্ষদেরই অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘হাজারো একটা কাজের মধ্যে দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়া পুলিশের একটা কাজ। আর দূষণ রোধের জন্যই পর্ষদের সৃষ্টি। দায়িত্ব তার অনেক বেশি।’’
এক যুগ আগের কথা। দেওয়ালির মাঝরাতে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে জলসা হচ্ছে বলে বিরক্ত এক জেলাশাসক ফোন করেন এসপি-কে। কিন্তু কাজ হয়নি। ক্ষুব্ধ জেলাশাসক এর পর পর্ষদের কন্ট্রোল রুমে ফোন করে এসপি-র বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে বলেন। তখন এতটাই ভরসার জায়গা ছিল পর্ষদ।
আর এখন শব্দদানবের দৌরাত্ম্য যত বাড়ছে, পর্ষদের স্বর যেন ততই ক্ষীণ। কিংবা পর্ষদ দুর্বল বলেই ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে শব্দদৈত্য।
একদা জুন-জুলাই মাসে পর্ষদ ও পুলিশের সমন্বয় বৈঠক শুরু হত শব্দদানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে। পুলিশকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হত, আইনের দিকগুলোও বুঝিয়ে দিত পর্ষদ। এ বছর সেই বৈঠক হয়নি বললেই চলে।
সম্ভবত সেই জন্যই তিন দিন আগে হরিশ মুখার্জি রোডে বিসর্জনের মিছিলে বিকট শব্দে পর পর বাজি ফাটার বিষয়টি কর্তব্যরত সার্জেন্টকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘‘এগুলো নিশ্চয়ই ৯০ ডেসিবেলের মধ্যে।’’
তিনি জানেনই না যে, ওই মাত্রার মধ্যে শব্দবাজি তৈরিই সম্ভব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy