থানা হামলায় মাথা বাঁচাচ্ছে পুলিশ।—ফাইল চিত্র।
একই শহর, একই উর্দি। অথচ কোথাও আইনরক্ষকের এক রকম নীতি, কোথাও তার বেবাক উল্টো!
যেমন, কোনও হাঙ্গামার সামনে তারা জড়োসড়ো হয়ে রীতিমতো কুঁকড়ে থাকছে। পরে ঠিকঠাক তদন্ত কিংবা সময়ে চার্জশিট দিতেও যেন হাত সরছে না! আবার কোথাও তাদের তৎপরতা দেখে কে! হাঙ্গামাকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করাই শুধু নয়, লোকজনকে পাকড়াও কোর্টে পেশ করতেও দেরি হচ্ছে না!
অবাক কাণ্ড! এমনটা কেন?
কলকাতা পুলিশেরই একাংশ অবশ্য এতে তেমন বিস্ময়ের কিছু দেখছে না। তাদের বক্তব্য, হাঙ্গামাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় যেখানে যেমন, পুলিশি আচরণও সেখানে তেমন। উল্টো দিকে শাসকপক্ষের ছোঁয়া দেখলে পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাদার মতো নরম হয়ে থাকে, যাকে মাড়িয়ে যেতে অসুবিধে হয় না। আবার বিরোধীদের সামনে সেই পুলিশই কিন্তু বজ্রের মতো কঠিন, নির্মম!
পুলিশের এ হেন রূপবদল মোটামুটি সব জমানাতেই কিছু না কিছু দেখা গিয়েছে। তবে ইদানীং এটা যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে বলে আক্ষেপ করছেন বাহিনীর প্রাক্তন ও বর্তমান অনেক অফিসার।
যার জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে সামনে আসছে বৃহস্পতিবারের বাম-মিছিল পর্ব। সে দিন বামেদের লালবাজার অভিযান ঠেকাতে পুলিশ শুধু বেপরোয়া লাঠিই চালায়নি, ঘটনাস্থলে তিন বাম সমর্থককে গ্রেফতারও করেছে। চন্দন বসাক, অমল পাল ও সৌমেন পাল নামে ধৃত তিন জনের নামে খুনের চেষ্টা, সরকারি কর্মীর কাজে বাধাদান, হাঙ্গামা পাকানো, বেআইনি জমায়েতের মতো হরেক অভিযোগে মামলা রুজু করেছে বৌবাজার থানা। এমনকী, শুক্রবার ধৃতদের ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করিয়ে চার দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতেও নিয়ে নিয়েছে!
যাকে বলে, দুরন্ত সক্রিয়তা। যার সুবাদে আইনরক্ষকদের সাধুবাদ প্রাপ্য হওয়ার কথা। পরিবর্তে জোরালো হয়ে উঠছে প্রশ্ন, সমালোচনা ও বিতর্ক। অভিযোগ উঠছে বৈষম্যমূলক আচরণের। কী রকম?
পুলিশেরই একাংশের আক্ষেপ, বিরোধী দমনে এমন সক্রিয়তা দেখালেও কাশীপুরে তুমুল গুলি-বোমাবাজিতে অভিযুক্ত শাসকদলের নেতাদের টিকি ছোঁয়ার সাহস দেখাতে পারেননি লালবাজারের কর্তারা। যে ভাবে আলিপুরে প্রকাশ্যে ওসি’কে নিগ্রহ করেও মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ নেতা পার পেয়ে গিয়েছেন। আবার রাসবিহারীতে মেয়রের ভাইঝি প্রকাশ্যে ট্রাফিক পুলিশকে হেনস্থা করলেও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। পুলিশই বলছে, আলিপুর, কাশীপুর বা রাসবিহারী, কোথাওই চার্জশিট হয়নি।
কলকাতা পুরভোটের মুখে, গত ১৪ এপ্রিল আলিপুরের গোপালনগর মোড়ে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সভা ঘিরে গণ্ডগোল বেঁধেছিল। খোদ আলিপুর থানার ওসি চন্দন রায়মুখোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে নিগৃহীত হন। এফআইআরে স্থানীয় তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা ও তাঁর দলবলের নাম রয়েছে। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং আলিপুর কোর্টে আগাম জামিন নিয়ে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গিয়েছেন মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ প্রতাপ!
কাশীপুরে ১৫ এপ্রিলের গুলি-বোমাবাজিতে নাম জড়ায় স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতার— স্বপন চক্রবর্তী ও আনোয়ার খান। কিন্তু কয়েক জন চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও দুই পাণ্ডার গায়ে হাত পড়েনি। আহত মুন্না সিংহের কৌঁসুলি অনুপম ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করা হয়েছে। ‘‘শিয়ালদহ কোর্টের সমন অগ্রাহ্যের বিষয়েও হাইকোর্টে আলাদা মামলা চলছে। তাতে বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাস পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।’’— বলেন অনুপমবাবু।
পুলিশমহলের অন্দরের খবর: নিচুতলার কর্মী-অফিসারদের অনেকেই চাইছেন উপরোক্ত ঘটনাগুলোয় রাজনৈতিক রং না-দেখে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু তাঁরা উপরতলার নির্দেশের বিরুদ্ধে যেতে পারছেন না। তাঁদের আশঙ্কা, শাসকদলের বিরুদ্ধে বেশি গা ঘামালে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসবে। এক ওসি’র দাবি, কাশীপুরে তদন্তকারী অফিসার (আইও) সিসিটিভির ফুটেজ জোগাড় করেছিলেন। ধৃত ও সাক্ষীদের বয়ানেও উল্লিখিত দুই নেতার নাম ছিল। চার্জশিট তৈরির আগেই সেই আইও’কে বদলি করে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে অন্য অফিসারকে।
ফলে নিচুতলায় ক্ষোভ-হতাশা দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ-সূত্রের খবর: শাসকদলের কারও বিরুদ্ধে তদন্তের নিয়ন্ত্রণ ইদানীং সংশ্লিষ্ট থানার এসআই বা ওসি’র হাতে থাকছে না। রাশ চলে চলে যাচ্ছে লালবাজারের শীর্ষ মহল আর শাসকদলের নেতাদের হাতে। খাস লালবাজারের এক অফিসারের পর্যবেক্ষণ, ‘‘বিরোধী দেখলেই কিছু কর্তা দারুণ সক্রিয় হয়ে উঠছেন। অন্য দিকে শাসকদলের কারও নামে মামলা হলে আইও’র উপরে ওঁরাই নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন।’’
এবং শাসকদলের তাঁবে থাকার হিড়িকে গোটা বাহিনীর মুখে চুনকালি পড়ছে বলে খেদ করছেন নিচুতলার বহু পুলিশকর্মী। যেমন, গত নভেম্বরে আলিপুরে সরকারি জমিতে দখলদার উচ্ছেদের প্রতিবাদে ভরদুপুরে থানায় চড়াও হয়েছিল এক দল দুষ্কৃতী। মাথা বাঁচাতে পুলিশ সে দিন টেবিলের তলায় ঢুকে ফাইল দিয়ে মুখ ঢেকেছিল। সে ছবি ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমে। ধিক্কার ওঠে সমাজের সর্বস্তরে। তার পরেও অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং পর দিন যে পাঁচ জনকে ধরে পুলিশ কোর্টে হাজির করে, তাঁদের কেউই আলিপুরের ত্রিসীমানায় থাকেন না! এক সিনিয়র অফিসারের মন্তব্য, ‘‘স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, পুলিশ স্রেফ দায়িত্ব এড়াতে ওঁদের ধরে এনেছে!’’
তখন মুখ বাঁচাতে আইও বদলানো হয়। বদলি হন আলিপুরের তদানীন্তন ওসি-ও। উল্লেখ্য, থানা-হামলাতেও ‘মাথা’ হিসেবে উঠে এসেছিল সেই প্রতাপ সাহার নাম। কিন্তু চার্জশিটে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ খাড়া করতে পারেনি আলিপুর থানা। সন্তোষপুরের তৃণমূল নেতা সঞ্জয় দাসের বিরুদ্ধে পুলিশ পেটানোর নালিশ থাকলেও তাঁর গায়ে আঁচ পড়েনি!
এমতাবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে পুলিশকে। লালবাজারের অন্দরমহলে কারও কারও অভিযোগ: এর ইঙ্গিত মিলেছিল ‘পরিবর্তনের’ জমানার সূচনাতেই। যে দিন (২০১১) জগদ্ধাত্রী বিসর্জন ঘিরে পুলিশের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়েছিল তৃণমূলপন্থী একটি ক্লাব। এবং মাঝ রাতে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়ে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! ‘‘রুলিং পার্টির লোক অপরাধ করলে পুলিশের ভূমিকা কী হবে, সেটা তো ওই রাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল!’’— কটাক্ষ এক অফিসারের।
বিরোধীদের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিকে এই ‘ট্র্যাডিশনেরই’ অন্য পিঠ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy