দু’জনের এক জন। বৃহস্পতিবার সকালেও হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে শুভঙ্কর পাত্র। তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন। — নিজস্ব চিত্র
অ়জ্ঞাতপরিচয়।
গভীর রাতে জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় জখম দুই যুবকের সম্পর্কে তথ্য ছিল এটুকুই। পরিণাম, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর পুলিশের ঠেলাঠেলিতে পরদিন সকাল পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসার বেশি আর কোনও পরিষেবা জুটল না তাঁদের। ভোরের দিকে একজনের মৃত্যুও হল। অভিযোগ, হাসপাতালের মেঝেয় পড়ে থেকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে প্রশান্ত বর্মন (২২) নামে ওই যুবককে।
বুধবার রাতে প্রায় দেড়টা নাগাদ হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে তেল ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় জখম হন মোটরবাইক আরোহী প্রশান্ত ও তাঁর বন্ধু শুভঙ্কর পাত্র। শুভঙ্কর বাইক চালাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় হেলমেটও ছিল। দুর্ঘটনার পরে প্রায় ৫০ ফুট দূরে তা ছিটকে যায়। জখম অবস্থায় দু’জনকে তমলুকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল নন্দকুমার থানার পুলিশ। প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের কলকাতার হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেন। কিন্তু নিয়ে যাবে কে? ওই যুবকদের পরিচয় যে তখনও জানা যায়নি! তাই পুলিশ কিংবা হাসপাতাল, কেউই জখমদের স্থানান্তরিত করার গরজ দেখায়নি। বৃহস্পতিবার সকালে মোটরবাইকের নম্বরের সূত্র ধরে যখন দু’জনের পরিচয় পুলিশ জানতে পারল, ততক্ষণে প্রশান্তর মৃত্যু হয়েছে।
প্রশান্ত ও শুভঙ্করের বাড়ি নন্দকুমারের কলাগেছিয়ায়। এ দিন জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, সকাল সাড়ে ১০টাতেও পুরুষ সার্জিক্যাল বিভাগের মেঝেতে পড়ে শুভঙ্কর। তাঁর রক্তে ভেজা শার্টটিও খুলে দেয়নি কেউ। যন্ত্রণায় ছটফট করলেও কোনও চিকিৎসা হয়নি বলে অভিযোগ। তবে নাকে সেলাই পড়েছে, আর লাগানো ছিল অক্সিজেনের নল। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তাঁর হাত, পা ও কোমরের হাড় ভেঙেছে। চোট আছে মাথাতেও। পরে তাঁকে তমলুকের নার্সিংহোমে নিয়ে যান পরিজনেরা। তাঁরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন। লিখিত অভিযোগ হয়নি। ওই গরিব শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা জানেনই না কোথায় লিখিত অভিযোগ করতে হয়।
শুভঙ্করের দাদা নবকুমার পাত্র বলেন, ‘‘কোথায় অভিযোগ করব জানি না। তা ছাড়া, এখন আমরা ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত।’’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শুভঙ্কর চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে। তবে রাতে চিকিৎসা শুরু করলে ভাল হতো। পরিজনদের ধারণা, রাতে চিকিৎসা শুরু হলে হয়তো বেঁচে যেতেন প্রশান্তও। তাঁর বাবা মোহন বর্মন বলেন, ‘‘রাতে ছেলে বাড়ি ফেরেনি বলে খোঁজাখুঁজি করেছিলাম। পুলিশ বলেছিল ছেলে জখম। এখানে এসে দেখি, সব শেষ।’’ আর প্রতিবেশী চন্দন বর্মনের বক্তব্য, ‘‘পুলিশ তো পারত কলকাতায় নিয়ে যেতে!’’ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমলও বলেন, ‘‘হাসপাতাল বা পুলিশ—অন্তত কোনও এক পক্ষ দায়িত্বটা নিতেই পারত। যা ঘটে গেল তা দুর্ভাগ্যজনক।’’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য পুলিশের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। জেলা হাসপাতাল সুপার গোপাল দাস বলেন, ‘‘দুই যুবকের আঘাত গুরুতর ছিল। এখানে যতটা সম্ভব চিকিৎসার পরে কলকাতা ‘রেফার’ করা হয়েছিল। তবে পুলিশ স্থানান্তরের দায়িত্ব নেয়নি।’’
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও একটি রায়ে জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় জখম কোনও ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উদ্ধারকারীকে কোনও ভাবে হয়রান করতে পারবে না পুলিশ। তাহলে এ ক্ষেত্রে তা হল না কেন?
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া এ দিন ফোন ধরেননি। তবে নন্দকুমার থানার ওসি অজয় মিশ্র বলেন, ‘‘রাতে ওঁদের পরিচয় জানা যায়নি। জেলা হাসপাতাল সুপারিশ করলেও আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব আমরা কী ভাবে নেব?’’
এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্বটা কার? যেখানে পুলিশ দায় এড়াচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষই বা কী করবে? প্রশ্নগুলো কিন্তু রয়েই গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy