Advertisement
২২ মে ২০২৪

‘আমাকে ফাঁসাল বিজেপি’, সৌরভ-হত্যায় রং রাজনীতির

রাজনৈতিক খুন নয়। খুনের পরে ঘটনা নিয়ে রাজনীতির দড়ি টানাটানিও হতে দেয়নি নিহতের পরিবার। শাসক আর বিরোধী— সব পক্ষকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল তারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

রাজনৈতিক খুন নয়। খুনের পরে ঘটনা নিয়ে রাজনীতির দড়ি টানাটানিও হতে দেয়নি নিহতের পরিবার। শাসক আর বিরোধী— সব পক্ষকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল তারা। কিন্তু বামনগাছির প্রতিবাদী কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরী খুনের কুড়ি মাস পরে মামলার রায় ঘোষণার দিন, শুক্রবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল সেই রাজনীতিই।

ভোট দুয়ারে কড়া নাড়ছে। ওই ছাত্রের বাড়ি বারাসত বিধানসভা কেন্দ্রের এলাকায়। সেখানে ভোট ২৫ এপ্রিল। আর এই হত্যা মামলার ফয়সালার দিনেই পুরো বিষয়টিতে লেগে গেল নির্বাচনী রাজনীতির রং। সেই রং ছেটানোয় শাসক দল তৃণমূল বা প্রধান বিরোধী বাম শিবির, কেউই পিছিয়ে থাকেনি। এমনকী মূল অভিযুক্তের জবানিতে জুড়ে গেল বিজেপি-ও। সৌরভ-হত্যায় অভিযুক্ত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনকেই এ দিন দোষী সাব্যস্ত করেছে বারাসত আদালত। আজ, শনিবার শাস্তি ঘোষণা করার কথা। এ দিন রায়ের পরে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট মিছিল করে এবং তৃণমূল জমায়েত করে দাবি করেছে, ‘এটা আমাদের জয়।’ আর রায় ঘোষণার পরে আদালত-চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রধান অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত শ্যামল কর্মকারের দাবি, ‘‘বিজেপি-ই আমাকে ফাঁসিয়েছে।’’

শ্যামল কি তৃণমূল করে?

প্রশ্ন শুনেই পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে রুদ্রমূর্তিতে সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে আসে শ্যামল। মারমুখী ভঙ্গিতে সে এবং তার শাগরেদ সোমনাথ সর্দার বলে, ‘‘ক্যামেরা ভেঙে দেবো!’’ জনা দশেক পুলিশকর্মী সামলান তাদের।

৩১ জানুয়ারি কামদুনি মামলায় শাস্তি ঘোষণার পরে ফাঁসির আসামি আনসার আলি তেড়ে মারতে গিয়েছিল ধর্ষিত ও নিহত ছাত্রীর স্বজনদের। কামদুনির ঘটনায় প্রথম থেকেই জড়িয়ে গিয়েছিল রাজনীতি। প্রতিবাদী মৌসুমী ও টুম্পা কয়ালকে ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এলাকায় সমাজবিরোধী কাজের প্রতিবাদে সরব সৌরভ খুন হয়ে যাওয়ার পরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজনীতিকে কিন্তু ঠেকিয়েই রেখেছিল তাঁর পরিবার। এ দিন আর পারল না।

বিরাটি কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌরভের ‘অপরাধ’ ছিল, বিকেল গড়াতেই বাড়ির আশেপাশে যারা চোলাই মদ ও সাট্টার ঠেক বসাত এবং মহিলাদের উদ্দেশে কটূক্তি করত, তাদের কাজের প্রতিবাদ করা। সেটা করতে গিয়েই সৌরভ ওই তল্লাটের কুখ্যাত দুষ্কৃতী শ্যামল কর্মকার ও তার দলের স্বার্থে মোক্ষম আঘাত হানেন বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

তার পরিণামে ২০১৪-র ৪ জুলাই রাতে বাড়ির সামনে থেকে বেমক্কা নিখোঁজ হয়ে যান সৌরভ। রাতভর খুঁজেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরের দিন বারাসত ও দত্তপুকুরের মধ্যে রেললাইনের ধারে ওই কলেজছাত্রের ক্ষতবিক্ষত ও খণ্ডিত দেহ মেলে। তার পরে এলাকার সব চোলাই মদের ভাটি, ঠেক ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। ওই নৃশংস খুন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শাসক দল ও বিরোধীরা। তবে সব পক্ষকেই ফিরে যেতে হয় সৌরভের পরিবারের আপত্তির মুখে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাসের হত্যাকাণ্ডের পরে ঠিক যে-ভাবে নেতাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল বারাসত। সেই রাজীব, দিদির আব্রু রক্ষা করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছুরিতে যে প্রাণ দেয়।

সৌরভ-হত্যায় অভিযুক্ত ১৩ জনকে এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ বারাসত আদালতে আনা হয়। তাদের আদালতে ঢোকানোর সময়ে প্রশ্ন ওঠে, কে শ্যামল? সাংবাদিকদের সেই প্রশ্নের জবাবে, প্রিজন ভ্যান থেকে এগিয়ে এসে শ্যামল কর্মকার বলে, ‘‘আমিই শ্যামল। তো? যা বলার, ভিতর থেকে ঘুরে এসে বলছি।’’

বেলা সওয়া ২টো নাগাদ সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দামনপ্রসাদ বিশ্বাস রায় ঘোষণা করেন। অনুপ তালুকদার নামে এক জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। তাঁর আইনজীবী জানান, ঘটনার আগেই পা ভেঙে বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন অনুপ। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও দমদম সেন্ট্রাল জেলের সুপারের দেওয়া প্রমাণপত্র দেখান আইনজীবীরা। শ্যামল-ঘনিষ্ঠ অনুপ এই মামলায় রাজসাক্ষী। সব শুনে বিচারক তাঁকে বেকসুর খালাস দেন।

উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘খুনের পরে অপরাধীরা এমন ভাবে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তাদের ধরতে গিয়ে আমাদের চারটি দলকে লাগাতার কাজ করে যেতে হয়। সকলকে গ্রেফতার করে চার্জশিট দেওয়া হয় ঘটনার ৪১ দিনের মাথায়। ভিসেরা পরীক্ষা আর ৪২ জনের সাক্ষ্যে সবই প্রমাণিত হয়েছে।’’

সরকারি কৌঁসুলি বিপ্লব রায় বলেন, ‘‘দোষীদের মধ্যে ন’জনের বিরুদ্ধে যে-ধারা দেওয়া হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন) এবং তিন জনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার সংস্থান আছে আইনে।’’

সৌরভের দাদা সন্দীপ চৌধুরী আদালত-চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে আমরা কোনও রাজনীতি হতে দিইনি। তাই বোধ হয় শাসক দলের পক্ষ থেকে গো়ড়ায় আমার চাকরি ও পরিবারকে অর্থসাহায্যের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।’’

তৃণমূলের আইনজীবী সংগঠনের সদস্যেরা বারাসত আদালতে স্লোগান দেন। সংগঠনের নেতা অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘রায়ে প্রমাণিত, রাজ্যে সুশাসন রয়েছে। এটা আমাদের জয়।’’ ডিওয়াইএফ এবং মহিলা সমিতি এ দিন মিছিল করে আদালতের সামনে পৌঁছয়। ডিওয়াইএফের বারাসত জোনাল কমিটির সম্পাদক দিলীপ সাহার দাবি, ‘‘আমরা রাজনীতি করতে যাইনি। এক যুবক খুন হয়েছেন। তাঁর খুনিরা শাস্তি পেল। সেটাই বড় জয়।’’ মিছিল করেছিল বিজেপি-ও। বারাসতের বিজেপি প্রার্থী বীথিকা মণ্ডল বলেন, ‘‘এটা আমাদের জয়।’’

সৌরভের বাবা, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী সরোজ চৌধুরী যে বিজেপির সমর্থক, সেটা গোড়াতেই জানা গিয়েছিল। সেই জন্যই দোষী সাব্যস্ত শ্যামল বিজেপি-কে দুষছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরোজবাবু আদালত-চত্বরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দলের জমায়েত, মিছিল দেখছিলেন ফ্যালফ্যাল করে।

‘‘ছেলেটা আইপিএল ক্রিকেট দেখতে দেখতে ঘরের বাইরে গেল। কোনও রাজনীতি করত না। কিন্তু এত লোক কারা,’’ প্রশ্ন সরোজবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sourav Choudhury Death Barasat Court Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE