Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

রাতভর ঘেরাও, তবু অনড় অনুরাধা

আইনি জটিলতার আশঙ্কায় নিয়মবিধির গণ্ডি ছাড়াতে রাজি নন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। আর প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে ভর্তির ব্যাপারে পড়ুয়ারাও অনড়। বুধবার এই দাবিতে রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনারকে রাত পর্যন্ত ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। আর বৃহস্পতিবার রাতভর আন্দোলনকারীদের হাতে ঘেরাও হয়ে থাকতে হল প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়াকে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ঘরে উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। (ডান দিকে) সেই ঘরের সামনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ঘরে উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। (ডান দিকে) সেই ঘরের সামনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

আইনি জটিলতার আশঙ্কায় নিয়মবিধির গণ্ডি ছাড়াতে রাজি নন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। আর প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে ভর্তির ব্যাপারে পড়ুয়ারাও অনড়। বুধবার এই দাবিতে রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনারকে রাত পর্যন্ত ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। আর বৃহস্পতিবার রাতভর আন্দোলনকারীদের হাতে ঘেরাও হয়ে থাকতে হল প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়াকে।

ভর্তির মাস দুয়েক বাকি থাকলেও ভর্তি-পদ্ধতি নিয়ে ঘেরাও আন্দোলন চালিয়েই যাচ্ছেন এক দল ছাত্রছাত্রী। নতুন ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, তা নিয়ে বর্তমান পড়ুয়াদের আগাম উদ্বেগের কারণ কী, তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।

আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের দাবি, প্রেসিডেন্সির মতো উৎকর্ষ কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় এর মান বজায় রাখার দায়িত্ব তাঁদেরও। তাই সচেতন নাগরিক এবং প্রেসিডেন্সির পড়ুয়া হিসেবে তাঁরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়া যদি একটি বিভাগেও ছাত্র ভর্তি হয়, তা হলে প্রতিষ্ঠানের মানের অবনমন ঘটবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। আর বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ বলছেন, ছাত্রছাত্রীদের এই আশঙ্কা অমূলক।

উপাচার্য অবশ্য এ দিনও জানান, প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে ছাত্র ভর্তি হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। পরীক্ষা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সব রকম সাহায্য করা হবে।

বিকেলে এক দল পড়ুয়া ঘেরাও করেন উপাচার্যকে। তাঁদের দাবি, সব বিভাগেই প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে ছাত্র ভর্তি করতে হবে। এবং এই বিষয়ে আলোচনার জন্য সব বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হবে কর্তৃপক্ষকে। উপাচার্য অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী পড়ুয়াদের এই দাবি মানা সম্ভব নয়।

কেন সম্ভব নয়, প্রশ্ন তুলেছেন আন্দোলনকারীরা। অমরদীপ সিংহ নামে এক ছাত্র বলেন, ‘‘এর আগে বিভিন্ন বিষয়ে সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বার কেন হবে না? দাবি না-মানলে অবস্থান চলবে। উপাচার্য চাইলে আমাদের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন।’’

উপাচার্য বুধবার বলেছিলেন, ঘেরাও-বিক্ষোভ চালিয়ে, জবরদস্তি করে কিছুই আদায় করা যাবে না। এ দিন তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক। নইলে আইনি জটিলতাও হতে পারে। তাই নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি কিছু করবেন না। একই বক্তব্য রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতিবাবুরও। রেজিস্ট্রার এবং অন্য কিছু কর্তা রাতে উপাচার্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে যান।

প্রেসিডেন্সিতে ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক চলছে কয়েক মাস ধরে। গত চার দশকের মতো প্রবেশিকার মাধ্যমেই ভর্তি হবে কি না, জল্পনা তা নিয়েই। এ দিন সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বিস্তারিত ভাবে কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানান অনুরাধাদেবী।

প্রবেশিকা বাদ দিয়ে কেন ভর্তির বিকল্প উপায়ের কথা ভাবতে হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দেন উপাচার্য। তাঁর বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় হাজার ছাত্রছাত্রীর বসার বন্দোবস্ত করা যায়। অথচ স্নাতক স্তরের ৫৪২টি আসনে ভর্তির জন্য গত বছর ২২ হাজার ছাত্রছাত্রী আবেদন করেছিলেন। চার দিনে পরীক্ষা হয়। উপাচার্যের কথায়, ‘‘প্রবেশিকার সময় দেখলাম, এক জন ছাত্রের প্রায় ঘাড়ে বসে আর এক জন পরীক্ষা দিচ্ছে। দু’জনের জায়গায় বসছে পাঁচ জন। বারান্দা, ছোট ছোট গবেষণাগারে পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে।’’ এ ভাবে পরীক্ষা হলে কী করে যথাযথ ভাবে যোগ্যতা বিচার করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন তুলেছেন উপাচার্য।

পরিস্থিতি দেখে এ বছর তাই ভর্তি-পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয় বলে জানান অনুরাধাদেবী। সুষ্ঠু ভাবে প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে সেপ্টেম্বরে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রেসিডেন্সি। কিন্তু নানা কারণে জয়েন্ট বোর্ড তাতে সাড়া দিতে পারেনি।

অনুরাধাদেবীর কথায়, ‘‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বাইরে কেন্দ্র করে পরীক্ষা নেয়। শহরের পাঁচটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে প্রবেশিকার বন্দোবস্ত করা যায় কি না, সরকারের কাছে সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের আলোচনা চলছে।’’ উপাচার্যের আশা, একটু সময় লাগলেও এই আলোচনায় ইতিবাচক ফল মিলবে। তা না-হলে হেয়ার, হিন্দু স্কুল বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যেতে পারে বলে জানান তিনি। অনুরাধাদেবীর দাবি, গত পাঁচ বছরের তথ্য ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, অনেক আবেদনকারীর দ্বাদশের নম্বরের সঙ্গে প্রবেশিকার ফলে সামঞ্জস্য আছে। সে-ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষা আলাদা করে কোনও সুবিধা করছে না বলে মনে করেন কর্তৃপক্ষ। এর ভিত্তিতেই বিভিন্ন বিভাগকে ভর্তি-প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে বলা হয়েছে।

গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা গভর্নিং বোর্ড (জিবি)-এর বৈঠকে ভর্তি-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের হাতে পরীক্ষা নেওয়া বা না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পরীক্ষা কেন্দ্র করার ব্যাপারে আলোচনা হয় বলে জানান উপাচার্য। তবে প্রশ্নপত্র তৈরি, মূল্যায়ন ও পরীক্ষায় নজরদারির দায়িত্ব বিভাগীয় প্রধানদেরই নিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের তা দেওয়া যাবে না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকে মনে করছেন, আগেভাগে এ ধরনের শর্ত চাপিয়ে কর্তৃপক্ষ আসলে হুমকি দিচ্ছেন। ভয় দেখিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত থেকে বিভিন্ন বিভাগকে নিরস্ত করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে তাঁদের অভিযোগ।

পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিতের মতো কয়েকটি বিভাগ প্রবেশিকা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। কিছু কিছু বিভাগ এখনও দোলাচলে। আবার ভূতত্ত্ব, প্রাণিবিদ্যার মতো কিছু বিভাগ প্রবেশিকা পরীক্ষা না-নেওয়ার পক্ষপাতী। যদিও কোনও বিভাগীয় প্রধানই মুখ খুলতে চাননি।

বিশেষ কোনও বিভাগের ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি উপাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘একটা জিনিস ছাত্রছাত্রী বা অন্য শুভার্থীরা বুঝতে পারছেন না। সেটা হল, প্রেসিডেন্সি এখন বিশ্ববিদ্যালয়। এর নিয়মবিধির বাইরে গিয়ে একনায়কের মতো কাজ করা সম্ভব নয়। বিভাগগুলির কিছু স্বশাসন আছে। ভর্তি-পদ্ধতি নিয়ে তাদের উপরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব।’’

অনুরাধাদেবী জানান, জুনের শেষ বা জুলাইয়ের গোড়ায় ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এখনও যথেষ্ট সময় আছে। ভর্তি কমিটি, জিবি-র পরবর্তী বিভিন্ন বৈঠকে আবার এই বিষয়ে আলোচনা হবে।

আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, কোন বিভাগে উপস্থিতির ন্যূনতম হার কত হবে, সেই ব্যাপারে তো বিভাগীয় স্বশাসনের তোয়াক্কা করা হয় না। তা হলে ভর্তি-পদ্ধতিতে স্বশাসনকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, উপস্থিতির হারের বিষয়টি ঠিক করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু করার নেই।

এর আগেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্সির পড়ুয়ারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। ক্লাসে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি না-থাকলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েও পরে নমনীয় হয়ে সাময়িক ভাবে সেই হার কিছুটা কমিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। ৭৫ শতাংশ হাজিরা না-থাকলে প্রেসিডেন্সিতে ভোট দেওয়া যাবে না বলে প্রথমে জানানো হয়েছিল। পরে সেখান থেকে কিছুটা সরে এসে উপাচার্য জানিয়েছিলেন, ভোট দেওয়া যাবে, কিন্তু প্রার্থী হওয়া যাবে না।

ছাত্র ভর্তির বিষয়টি পুরোপুরি কর্তৃপক্ষের এক্তিয়ারভুক্ত। এ ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের কিছু করার নেই। নিয়মের বাইরে গেলে আইনি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই কর্তৃপক্ষ নমনীয় হচ্ছেন না বলেই খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE