জেল থেকে বেরনোর পরে বাবাকে জড়িতে ধরেছেন দুই মেয়ে। বহরমপুর সংশোধনাগারে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
নব্বই বছরের সুফিয়া বিবির গলায় আছড়ে পড়ল প্রশ্নটা। বিড়বিড় করে বললেন, “তাহলে এই ক’টা বছর কে আমাদের ফিরিয়ে দেবে?” ওই প্রশ্নের সামনে দৃশ্যত চুপ মেরে গেল গোটা শেরপুর গ্রাম। নানুরের শেরপুর গ্রামেই বাড়ি সুফিয়া বিবির। স্থানীয় সুচপুর গণহত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে এতদিন জেলে ছিলেন সুফিয়া বিবির একমাত্র ছেলে কাজী আবুল কালাম। গত ১৬ মে তাঁকে বেকসুর খালাস করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। শুধু তাঁকেই নয়, একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আরও ১৮ জনকে একই ভাবে মুক্তি দিয়েছে আদালত। স্বভাবতই ওই সব মুক্তিপ্রাপ্তদের গ্রামে এখন খুশির হাওয়া বইছে। পাশাপাশি চলছে নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালতের ভূমিকা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ২০০০ সালে নানুরের সুচপুরে ১১ জন খেতমজুর খুন হন। ওই খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় করা সুচপুর গণহত্যাকে সামনে রেখে সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগিয়ে জেলায় তৃণমূল পথ চলা শুরু করে। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে লালদুর্গ হিসেবে খ্যাত নানুরের দু’টি পঞ্চায়েতেও ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল, কংগ্রেস ও বিজেপি জোট। দীর্ঘ দিন নানা টানাপোড়েনের পরে ২০১০ সালের নভেম্বরে সিপিএমের দাপুটে নেতা, নানুর জোনাল কমিটির সদস্য নিত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়-সহ ৪৪ জন সিপিএম নেতা-কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সাজা দেয় সিউড়ির জেলা আদালত। সেই থেকেই অভিযুক্তেরা সাজা খাটছেন। গত ১৬ মে তাঁদেরই মধ্যে ১৯ জনকে বেকসুর খালাস করেছে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং নিশীথা মাহাত্রের ডিভিশন বেঞ্চ। হাইকোর্টে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “একটি জমি সংক্রান্ত গ্রাম্য বিবাদে ওখানে এগারো জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার সঙ্গে রাজনীতিকে জড়িয়ে একটি গ্রামের ৪৪ জনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে সিপিএমেরও কিছু লোক ছিলেন। হাইকোর্ট ১৯ জনকে বেকসুর ঘোষণা করেছেন। বাকিরাও নিরপরাধ। তাঁদের মুক্তির জন্য আমরা সুপ্রিম কোটের্র দ্বারস্থ হব।”
অপেক্ষায় পরিবারের সদস্যরা। নানুরের শেরপুরে ছবি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
খালাসপ্রাপ্তদেরই অন্যতম শেরপুরের কাজী আবুল কালাম। এ দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধা মা সুফিয়া বিবিকে ঘিরে রয়েছেন পাড়া প্রতিবেশীরা। বৃদ্ধা কপাল চাপড়াচ্ছেন আর চোখের জল ফেলছেন। সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলেন, “ছেলেকে ছেড়ে এতদিন থাকতে হল। কেউ কি সেই দিনগুলো আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?” তারপরই আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে এলিয়ে পড়েন বৃদ্ধা। সে দিনের সেই রাতের ছবিটা আজও দুঃস্বপ্নের মতো চোখে ভাসে আবুল কালামের স্ত্রী রেজিনা বিবির চোখে। তিনি বলেন, “রাত তখন তিনটে। নাবালক দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে একই বিছানায় আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। দরজা ভেঙে পুলিশ এসে স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। এফআইআর-এ নাম না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে হত্যা মামলায় যুক্ত করে দেয়।” আবুল কালামের বেকসুর খালাসের খবরে খুশি গ্রামেরই বাসিন্দা গোলাপ শেখ, মনিজা বিবিরাও। তাঁদের প্রশ্ন, “উচ্চ আদালতে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে না বলে যাঁদের নিম্ন আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই এমন সাজা কাটতে হয়, তাঁদের পরিবারের কি হবে? যাঁদের গাফিলতিতে আইনের ফাঁক গলে নিরপরাধীরা সাজা পান কিংবা প্রকৃত অপরাধীরা খালাস হয়, তাঁদের কেন কোনও সাজা হবে না?”
একই প্রশ্ন তুলছেন, ব্রাহ্মণখণ্ডের মিনতি দে, নতুন গ্রামের মেহেরুন্নেসা বেগমেরা। সুচপুর গণহত্যা মামলাতেই মিনতিদেবীর স্বামী সুভাষচন্দ্র দে এবং মেহেরুন্নেসার স্বামী গুলাম মেহেবুবও যাবজ্জীবন সাজা পান। তাঁদেরও বেকসুর খালাস দিয়েছে উচ্চ আদালত। স্বামীর জেলে যাওয়ার পর থেকেই ছোট মেয়েকে নিয়ে বোলপুরে বাপের বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে মিনতিদেবীকে। ছ’ বছর আগে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মিনতিদেবী জানান, স্বামী যখন জেলে যান তখন ছোট মেয়ের মাধ্যমিকের টেস্ট চলছিল। জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে নামার আগেই তার পাশে বাবা ছিলেন না। মিনতিদেবী বলেন, “মেয়ে তখন বারবার বলত, ‘মা অন্য মেয়ের বাবারা পরীক্ষা শেষে ডাব, টিফিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই তখন আমার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে। চোখ ফেটে জল এলেও কিছু বলতে পারি না।” বাবার অভাব মিনতিদেবী কোনও দিনই পূরণ করতে পারেননি।
গল্পটা অনেকটাই একই রকম নতুনগ্রামের মেহেরুন্নেসারও। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে। মাথার উপরে অভিভাবক বলতে কেউ নেই। তিনি বলেন, “স্বামী আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ভেবেছিলেন ৯০ দিন পরে জামিনে ছাড়া পাবেন। কিন্তু তারই মধ্যে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করায় ওই সময়েই তাঁকে দু’বছর ন’ মাস জেল খাটতে হয়। তারপর এখন যাবজ্জীবন সাজা খাটতে হচ্ছিল।” তিনি জানান, পুরুষহীন একটি পরিবারে একা মহিলাকে কত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। ওই পরিবারের প্রতি সহমর্মী গ্রামেরই বাসিন্দা টিটু শেখ, হাদিসা বেগমদের প্রশ্ন, “মেহেরুন্নেসাকে চরম কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। কোনওরকমে ছেলেমেয়েকে মানুষ করছে। ওর যে ক্ষতি হয়ে গেল, তার দায় কে নেবে?”
পদ্ধতিগত কারণে এখনও কেউ-ই মুক্তি পাননি। শীঘ্রই মুক্তি পাবেন। তাঁরা গ্রামে ফিরলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবেন না বলেই আশা করেন তাঁদের পরিবারের স্বজনেরা। এ দিকে বাকিদের মুক্তির জন্যও যে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানাবেন, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিপিএমের স্থানীয় দায়িত্ব প্রাপ্ত জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্য। একই কথা জানিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ও। আবার দলগত ভাবে আলোচনা করে এ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যকারী সভাপতি অশোক ঘোষ। এ দিকে, মামলার প্রাক্তন সহকারি আইনজীবী তথা বর্তমানে বীরভূম জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবী রঞ্জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “রায় এখনও পড়ে দেখিনি। তবে, আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy