Advertisement
০৮ মে ২০২৪
পুলিশ ফাইল থেকে

কেন ছেলেকে ডেকেছিলাম, খেদ প্রৌঢ়ের

বিদ্যুৎহীন গ্রামে তখন মাঝরাত। ভরাবর্ষার রাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সঙ্গে ব্যাঙের ডাক। সাঁঝ নামতেই ঘরের দোর দিয়েছিলেন বাসিন্দারা।

এই পুকুর পাড়েই পড়েছিল দেহ। ছবি: উমাকান্ত ধর।

এই পুকুর পাড়েই পড়েছিল দেহ। ছবি: উমাকান্ত ধর।

দেবব্রত দাস
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০১:০১
Share: Save:

বিদ্যুৎহীন গ্রামে তখন মাঝরাত। ভরাবর্ষার রাতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সঙ্গে ব্যাঙের ডাক। সাঁঝ নামতেই ঘরের দোর দিয়েছিলেন বাসিন্দারা। সেই সময়েই অন্ধকার ফুঁড়ে উঠোনে কয়েকটা ছায়ামূর্তি উদয় হয়ে ডাক দিয়েছিল— “বাহাদুরখুড়া আছ না কী?” ঘর থেকে বেরোতেই প্রৌঢ়ের কানে বন্দুকের ঠান্ডা নল ঠেকিয়ে ছেলেকে ডাকতে বলেছিল জলপাই রঙের পোশাক পরা লোকগুলো। প্রাণভয়ে ছেলে সমীরকে ডেকেছিলেন বাহাদুরবাবু। বাবার ডাকে দরজা খুলে বেরোতেই বন্দুক হাতে উন্মত্তের দল মারতে মারতে সমীরকে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। পরের দিন ভোরে বারিকুলের নেকড়াপচা গ্রামে ঢোকার মোরাম রাস্তার পাশে নতুনবাঁধের পুকুরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেলে শ্যামসুন্দরপুর পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূল কর্মী সমীর পালের (৩৭) দেহ। মাথায় ও বুকে গুলির চিহ্ন ছিল। মৃতদেহের পাশে মাওবাদীদের নামাঙ্কিত ছ’টি পোস্টার মিলেছিল। সেই পোস্টারে ‘সিপিএমের দালাল ও পুলিশের চরকে চরম শাস্তি দেওয়া হল’ বলে লেখা ছিল।

২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগের ঘটনার। জঙ্গলমহলে লালগড় আন্দোলনের রেশ কিছুটা কমলেও নিজেদের অস্তিত্ব জানাতে ব্যস্ত মাওবাদীরা। রাতটা ছিল ২০১০ সালের ১৭ জুলাই। নেকড়াপচা গ্রামের বাসিন্দা, সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া পঞ্চায়েত সদস্য সমীর পালকে ‘সিপিএমের দালাল ও পুলিশের চর’ সন্দেহে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়। পুলিশের দাবি ছিল, মাওবাদীরাই তাঁকে খুন করেছে। যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব এই খুনের পিছনে সিপিএমের সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা জড়িত বলে অভিযোগ তুলেছিল। নিহতের বাবা বাহাদুর পাল বারিকুল থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। যার কেস নম্বর ২০/২০১০। এই হত্যার তদন্তে নামে পুলিশ। এফআইআর-এ অজ্ঞাতপরিচয় ২৫-৩০ জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়।

ঝাড়খন্ড জনমুক্তি মোর্চার প্রার্থী হিসাবে সমীরবাবু শ্যামসুন্দরপুর পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার মাস দুয়েক পরেই তিনি খুন হয়ে যান। সেই সময় জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের টার্গেট ছিলেন মূলত সিপিএম নেতা-কর্মীরা। তাই কেন তাঁকে মাওবাদীরা খুন করল, তা নিয়ে রহস্য রয়েই গিয়েছে পরিজনদের মধ্যে। তদন্তে নেমে পুলিশ এই খুনের পিছনে মাওবাদীদের বেলপাহাড়ি স্কোয়াডের ভৈরব মান্ডি-সহ কয়েকজন পলাতক স্কোয়াড সদস্য জড়িত বলে জানতে পারে। পরে ভৈরব মান্ডি-সহ ছ’জনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। তবে আদালতে ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট জমা না পড়ায় ধৃতেরা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। পুলিশ ঘটনার প্রায় তিন বছর পরে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। এখনও চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ।

গত ছ’ বছরে জঙ্গলমহলের চালচিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মাওবাদীদের অস্তিত্ব এখন বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে নেই বললেই চলে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মধ্য ত্রিশের সমীরবাবু চাষাবাদের সঙ্গে চুটিয়ে রাজনীতি করতেন। গ্রামে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। সেই রাতের কথা আজও ভুলতে পারেননি নিহতের বাবা বাহাদুরবাবু।

তাঁর কথায়, “রাত তখন প্রায় ১২টা হবে। ছেলে, বৌমা ও নাতি-নাতনিরা একটা ঘরে ছিল। আমি সামনের ঘরে ছিলাম। হঠাৎ কারা আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে দেখে বের হই। দেখি জলপাই পোশাক পরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে। মুখ ঢাকা। ওদের হাতে বন্দুক। আমার কানের কাছে বন্দুক ঠেকিয়ে সমীরকে ডাকতে বলে ওরা। ভয়ে ওকে ডাকি। সমীর দরজা খুলতেই ওরা ওকে ধরে নিয়ে মারতে মারতে চলে যায়। যদি জানতাম ওকে ওরা প্রাণে মেরে ফেলবে, তাহলে আর ডাকতাম না।’’ ছ’বছর ধরে এই আক্ষেপ তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

নিহতের স্ত্রী আহ্লাদি বলেন, “স্বামীর সঙ্গে আমিও উঠেছিলাম। হ্যারিকেনের আলোর দম বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি করেছিলাম। ওরা হ্যারিকেনটা ফেলে দিয়ে আমাদের ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়ে যায়। সারারাত আতঙ্কে জেগে ছিলাম। ভোরে দুঃসংবাদ পাই।’’ তাঁর আক্ষেপ, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষতিপূরণের তিন লক্ষ টাকা তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাননি। তাঁকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি পরে শিশু কল্যাণ মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু আহ্লাদি আর সেই চাকরি পাননি। অভাবের তাড়নায় এখন দুই মেয়ে ও ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখে তিনি পড়াচ্ছেন। অসহায় চোখে এখনও তিনি জানতে চাইছেন, ‘‘স্বামীকে মেরে আমাদের পরিবারটাকে ভাসিয়ে ওরা কী সুখ পেল? সুবিচার কি আর পাওয়া হবে না?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police file special story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE