Advertisement
০৮ মে ২০২৪
নিশানায় পুলিশ কর্তার পরিবার

চুরির অভিযোগে আছড়ে মার

স্কুল থেকে হোমে ফেরার পথে লুকিয়ে পুলিশ আধিকারিকের বাড়িতে ঢুকে গাছ থেকে ডাব পাড়ার চেষ্টা করেছিল সে। সেই অপরাধে সিউড়ির এক সরকারি হোমে থাকা বছর বারোর বালককে মাটিতে আছড়ে ফেলে, লাঠিপেটা করার অভিযোগ উঠল আইবি-র ডিএসপি পদমর্যাদার ওই আধিকারিকের পরিজনদের বিরুদ্ধে।

সিউড়ি হাসপাতালে অসুস্থ লক্ষ্মণ কিস্কু। (ডান দিকে) পুলিশ কর্তার এই বাড়িতেই মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

সিউড়ি হাসপাতালে অসুস্থ লক্ষ্মণ কিস্কু। (ডান দিকে) পুলিশ কর্তার এই বাড়িতেই মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৫
Share: Save:

স্কুল থেকে হোমে ফেরার পথে লুকিয়ে পুলিশ আধিকারিকের বাড়িতে ঢুকে গাছ থেকে ডাব পাড়ার চেষ্টা করেছিল সে। সেই অপরাধে সিউড়ির এক সরকারি হোমে থাকা বছর বারোর বালককে মাটিতে আছড়ে ফেলে, লাঠিপেটা করার অভিযোগ উঠল আইবি-র ডিএসপি পদমর্যাদার ওই আধিকারিকের পরিজনদের বিরুদ্ধে।

শুক্রবার জেলা প্রশাসনের কাছে ওই পরিবারের বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন হোম কর্তৃপক্ষ। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্র লক্ষ্মণ কিস্কু নামে ওই বালককে সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, লক্ষ্মণের মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। সুপার শোভন দে জানিয়েছেন, ছেলেটির সিটিস্ক্যান কারানো হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই তবেই পরিস্থিতি বলা সম্ভব। হোমের সুপারিনটেনডেন্ট কাকলি কুণ্ডু এহেন মারধরের ক্ষোভ গোপন করেননি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘অত্যাচারের মাত্রা এবং নিষ্ঠুরতা এতটাই ছিল যে মনের আঘাত ছাপিয়ে গিয়েছে শরীরের আঘাতকে!’’

সিউড়ির কলেজ পাড়ায় রয়েছে সরকারি স্টেট ওয়েলফেয়ার হোম। অর্থনৈতিক ভাবে পিছনের সারিতে থাকা পরিবারগুলি থেকে পড়ুয়ারা এখানে থেকে পড়াশোনো করে। কারা এই হোমে থেকে পড়াশোনোর সুযোগ পাবে সেটা ঠিক করে একটি কমিটি। পদাধিকার বলে সেই কমিটি এবং হোমের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) এনাউর রহমান। মোট ৯৬ জন পড়ুয়া রয়েছে এই হোমে। হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনাটি ঘটে বুধবার বিকালে। ওই হোমের কাছেই রয়েছে বাণী মন্দির স্কুল। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে লক্ষ্মণ।

ঠিক কী হয়েছিল?

বুধবার বিকেলে স্কুল থেকে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিল লক্ষ্মণ আর সুমন্ত বাউরি নামে আর এক ছাত্র। ওই পথে রয়েছে দুর্গাপুর আইবি-তে কর্মরত ডিসপি পদমর্যাদার পুলিশ আধিকারিক গৌর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। হোমের একটি সূত্রের অনুমান, ওই বাড়ির গাছে প্রচুর ডাব দেখে হয়তো লোভে পড়ে গিয়েছিল বালক দুটি। পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে পড়ে লক্ষ্মণ। পাহারায় ছিল সুমন্ত। কিন্তু বন্ধু ধরা পড়তেই পালিয়ে হোমে পৌঁছে যায় সুমন্ত। হোমে ফিরেও সুমন্ত ভয়ে সে কথা জানায়নি কর্তৃপক্ষকে। ঘটনার কথা জানাজানি হয় সন্ধ্যায়। সুপারিনটেনডেন্ট কাকলীদেবী বলেন, ‘‘রোল কল করতে গিয়েই বিষয়টি নজরে আসে। পুলিশে অভিযোগ করতে যাব ভাবছিলাম তখনই সুমন্ত বলে লক্ষ্মণকে আটকে রেখেছে ওই পরিবার।’’

দ্রুত হোমের কয়েক জনকে নিয়ে গৌরবাবুর বাড়িতে পৌঁছন তিনি। কাকলীদেবীর অভিযোগ, ‘‘অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেন ওঁর পরিবারের সদস্যরা। বলেন, আমরা ছেলেটাকে পুলিশে দিয়েছি। ওই রাতেই সিউড়ি থানায় যাই। গিয়ে দেখি ঠকঠক করে কাঁপছে। বারবার একটা কথাই বলছিল দিদি এমনটা আর হবে না! এতটা ভয় পেয়েছিল সে।’’ হোমে নিয়ে আসতে চাইলে পুলিশ ‘সুস্থভাবে ছেলেটিকে ওঁদের হেফাজত থেকে পেলাম’ লিখিয়ে ছেড়ে দেয় বলে জানিয়েছেন কাকলিদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘তখনও বুঝিনি কী পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে ওর উপরে!’’

সদাইপুর থানার কচুজোর থেকে বৃহস্পতিবার লক্ষ্মণের বিধবা মা হতদরিদ্র রুবি কিস্কুকে ডাকা হয়। রুবি শুধু অনুরোধ করেন ছেলেকে যেন হোম থেকে বাড়ি না পাঠানো হয়। হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, ছেলেদের মধ্যে কেউ অসুস্থ কিনা তা জানতে প্রতি দিন নিয়ম করে খবর নেওয়া হয়। সেটা যাচাই করতে গিয়েই শুক্রবার সকালে জানা যায় লক্ষ্মণের উপরে কী পরিমাণ অত্যাচার হয়েছে। কাকলিদেবীর দাবি, ‘‘ওকে মাটিতে আছড়ে ফেলা হয়েছে। লাঠি দিয়ে মাথায় এত মেরেছে যে, দু’দিন পরেও ফুলে রয়েছে পিছনের দিকটা। তখনই জেলা প্রশাসন ও পরে চাইল্ড প্রটেকশন অফিসারকে জানাই।’’ মারধরের কথা জেনে ওই পুলিশ আধিকারিকের পরিবারের বিরুদ্ধে সিউড়ি থানায় অভিযোগ করেছেন জেলা জন-শিক্ষা প্রসার আধিকারিক মহম্মদ হাসিমউদ্দিনও।

শুক্রবার বিকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মণ উপুর হয়ে শুয়ে। বিমর্ষ ভাবে পাশে বসে রয়েছেন মা রুবি কিস্কু। তিনি কিছু বলতে চাননি। তবে হোমের এক আধিকারিক দাবি করেন, ‘‘মারধরের পরে ওই পরিবারটি লক্ষ্মণকে রীতিমতো শাসিয়েছিল। কোনও ভাবে কথাটা কাউকে বললে আরও মারার হুমকিও দেয়। তাতেই আরও গুটিয়ে যায় ও!’’

যে পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই পরিবারের কর্তা তথা পুলিশ আধিকারিক গৌরবাবু বালকটির উপরে অত্যাচারের কথা মানতে চাননি। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘হোমের ছেলেরা প্রায়ই পাড়ায় চুরি করে। সে দিন হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় ওকে থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়। কেউ মারধর করেনি।’’ তা হলে আঘাতের চিহ্ন এল কোথা থেকে? সদুত্তর না দিয়ে তাঁর অভিযোগ, ‘‘আসলে এ ভাবে পাড়ায় চুরি আটকাতে হোম সুপারকে অনুরোধ করেছিলাম। অন্যথায় প্রশাসনে জানানোর কথাও বলেছিলাম। তার প্রতিশোধ নিতেই ঘটনার দু’দিন পরে ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আমাদের বিপাকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে!’’ এমন দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন কাকলিদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

stealing beaten
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE