Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

লড়ে জিতল বাহারা

সোমবার জিতে গেল এই তিন মেয়েরই লড়াই। হোমে থেকে পড়াশোনা করে প্রত্যেকেই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। নারায়ণপুরের অর্পিতা ভকত, সৈপুর গ্রামের আসরিনা খাতুন এবং তুম্বনি গ্রামের বাহা হাঁসদা।

তিন কৃতী। সোমবার দুপুরে রামপুরহাটের হোমে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

তিন কৃতী। সোমবার দুপুরে রামপুরহাটের হোমে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

ঘটনা ১: বাবা খুন হয়ে যাওয়ায় একপ্রকার অনাথই হয়ে পড়েছিল পাঁচ বছরের শিশুটি।

ঘটনা ২: তাকে জন্ম দিতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছিল মায়ের। কিছু পরে ছোট্ট মেয়েটি হারায় বাবাকেও।

ঘটনা ৩: গাঁ-গঞ্জ ঘুরে বাবার চিরুনি-স্নোপাউডার ফিরি থেকেই চলে তাদের পাঁচ ভাইবোনের সংসার।

সোমবার জিতে গেল এই তিন মেয়েরই লড়াই। হোমে থেকে পড়াশোনা করে প্রত্যেকেই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। নারায়ণপুরের অর্পিতা ভকত, সৈপুর গ্রামের আসরিনা খাতুন এবং তুম্বনি গ্রামের বাহা হাঁসদা। তিন জনেরই বর্তমান ঠিকানা রামপুরহাটের নিশ্চিন্তপুরের সরকারি হোম পুষ্পরাগ নিকেতন। অর্পিতার প্রাপ্ত নম্বর ৩০৮, আসরিনার ২৮৬, বাহা পেয়েছে ২২৮ নম্বর। পড়াশোনার পাশাপাশি তিন মেয়েই হোমে উল বোনা, সেলাই ও এমব্রয়ডারির কাজ শিখছে। একসময় যাদের পড়াশোনাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, উচ্চ শিক্ষিত হয়ে জীবন-যুদ্ধে স্বাবলম্বি হতে পারাটাই এখন তাদের স্বপ্ন।

হোমের সুপার তাপসী সালুই এ দিন জানান, অর্পিতার মা ছোট ছেলেকে নিয়ে বিধবা ভাতার সামান্য টাকায় কোনও রকমে সংসার চালান। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে মেয়ের কথা ভেবে তিনি এই হোমে যোগাযোগ করেন। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে অর্পিতা হোমে থাকতে শুরু করে। ওই বছরই ডিসেম্বরে হোমে আসে আসরিনা। আর গত অগস্ট থেকে থাকতে শুরু করে বাহাও। তাপসীদেবীর কথায়, ‘‘তিন জনেরই মাধ্যমিক পাশ করার পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকারি সাহায্য পেয়ে ওরা এখানে ভোকেশনাল কোর্স-সহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। অর্পিতা রামপুরহাট রেলওয়ে আদর্শ বিদ্যাপীঠ, আসরিনা বৈধরা হাইস্কুল এবং বাহা তুম্বনী রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ থেকে পরীক্ষা দেয়।”

এই সময়-পর্বে তাপসীদেবীই সব রকম ভাবে বাহাদের পাশে থেকেছেন। কোনও প্রাইভেট টিউটর ছিল না। তাপসীদেবীর কাছেই পড়েছে ওরা। অর্পিতার কথায়, ‘‘আমার পাঁচ বছর বয়সে বাবা খুন হন। তার পরে দাদুরা মাকে আলাদা করে দেয়। মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে কোনও রকমে আলাদা সংসার চালাতে থাকে।’’ পরে অর্পিতার ঠাঁই হয় নারায়নপুরের একটি মিশনে। ২০১৩ সালে সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অন্য দিকে, জন্ম দেওয়ার পরেই হাসপাতালে মারা যান বাহার মা। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরে তিনিও মারা যান। নারায়ণপুরের মিশন থেকে ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করে বাহা। অর্পিতার মতোই এর পরে তারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের তাড়নায় ওই একই বছরে মাধ্যমিক পাশ করলেও পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল আসরিনাকেও। তার বাবা গ্রামে গ্রামে সাইকেলে করে চিরুনি, টিপের মতো সস্তার প্রসাধনী জিনিস ফেরি করে বেড়ান। সেই রোজগারে কোনও রকমে চলে বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোনের সংসার। সমাজে নানা ভাবে কোণঠাসা হতে থাকা এই তিন মেয়েরই জীবনের ছবিটা বদলে যায় ওই হোমে আশ্রয় মেলার পরে।

এই তিন লড়াকু মেয়েরই ইচ্ছে, হোমে থেকে স্নাতক হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া। সে পথে অবশ্য এখনও অনেক বাধা। অর্পিতারা বলছে, ‘‘এই হোমের আমরা স্বল্পকালীন আবাসিক। এখানে আর বছর দেড়েক থাকার সুযোগ পাব। কিন্তু এর পরে কোথায় যাব? কী করেই বা পড়াশোনার খরচ চালাব?’’ সেই চিন্তায় এখন থেকেই তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। হোমের অফিস স্টাফ সোমনাথ প্রামাণিক বলছেন, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী স্বল্পকালীন হোমে তিন বছরের বেশি থাকা যায় না। ওরা প্রায় দেড় বছর ধরে এখানে রয়েছে।’’ তবে, আপাতত তিন জনকে কলেজে ভর্তি করার ব্যাপারেই মনোযোগ দিতে চান তিনি। তার পরে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাহারা যাতে এই হোমে স্নাতক পর্যন্ত থাকতে পারে, তার চেষ্টা করবেন তিনি সোমনাথবাবু আশ্বাস দিয়েছেন।

তিন মেয়ের এই উত্তরণে এমন পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবে বলে মনে করছেন জেলা চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার নিরূপম সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘ওই তিন কৃতী মেয়ের জন্য আমরা গর্বিত। ওদের সব রকম ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব আমরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

orphan student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE