রাস্তা অচল
হরতালের প্রতিবাদে জনজীবন সচল রাখার দাবিতে জমায়েত করেছিল শাসকদল। কিন্তু সেই জমায়েতের ভিড়ে ঠেলায় রাস্তাই অচল হওয়ার উপক্রম হল! সোমবার সকালে মানবাজারের ইন্দকুড়িতে মন্ত্রী সন্ধ্যারানি টুডুর স্বামী গুরুপদ টুডু দলের কর্মীদের নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তাতেই রাস্তায় গাড়ি চলাচল ব্যাহত হয়। গুরুপদবাবু এক পুলিশ আধিকারিককে সামনে পেয়ে জানতে চান, ‘‘সব ঠিক আছে তো?’’ পুলিশ আধিকারিকের জবাব, ‘‘হরতালের ডাক দেওয়া রাজনৈতিক দল তো রাস্তায় নামেনি, কিন্তু আপনাদের জমায়েতেই রাস্তা প্রায় বন্ধ হতে বসেছে।’’ পিছন ফিরে গুরুপদবাবুও দেখেন, সত্যিই তো তাই। তাঁর দলের কর্মীদের ভিড়ে রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ। পিছনে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। নেতা সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা করে দিতে নির্দেশ দিলেন ।
বন্ধে লাভ
যে দলই বন্ধ বা ধর্মঘট ডাকুক না কেন ঝামেলা এড়াতে দোকান বন্ধই রাখতেন বাঁকুড়ার ভৈরবস্থানের মিষ্টি ব্যবসায়ী গোপালচন্দ্র বরাট। তবে নোট বাতিল হওয়ার পর তাঁর ব্যবসায় বড় চোট লাগে। সেই অবস্থা অবশ্য অনেকটাই কাটিয়ে ব্যবসা আগের মতো চলতে শুরু করেছে সবে। এরই মাঝে বামেরা হরতাল ডেকে দেওয়ায় বিব্রতই হয়েছিলেন তিনি। তাই এ বার বন্ধে দোকান বন্ধ না করে বরং খোলেন তিনি। বিক্রিবাটাও মন্দ হল না। গোপালবাবুর কথায়, “বন্ধের দিনেও এত ভাল ব্যবসা হবে ভাবতে পারিনি।’’ একই অভিজ্ঞতা শহরের কালীতলা এলাকার মুদি দোকানি জনার্দন দত্তেরও। জনার্দনবাবু বলেন, “নোট বাতিলের চক্কবরে প্রায় দু’সপ্তাহের মন্দা কাটিয়ে সবে ব্যবসা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় দোকান বন্ধ রাখার প্রশ্নই নেই। ব্যবসাও ভালই হয়েছে।”
বাসই বাস
বাস পাব তো? বাড়ি থেকে গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে বহুবার এই একটা প্রশ্নই আওড়ে গিয়েছেন বাঁকুড়ার বাসিন্দা প্রদীপ সামন্ত। কারণ বিরোধীদের ডাকা হরতাল ও শাসকদলের কলকাতায় মিছিলের যাওয়ার টানে সাধারণের ভাগে বাস থাকবে কি না সংশয় ছিল। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখেন, এ দিনটা ব্যতিক্রম। অন্য দিনগুলোর মতোই বাসে যাত্রী তোলার জন্য কন্ডাক্টরদের হাঁকডাক চলছে। অবাক হয়ে তিনি বলে ফেলেন, “বন্ধের দিনেও এত বাস!’’ জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক দীপক সুকুল জানান, সরকারি ও বেসরকারি সব বাসই রুটিন মাফিক চলেছে।
ফুলমার্কস
বন্ধে সাড়া দিলে লাভ নেই। সরকারি কর্মীদের আগেই তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজও মিলেছে। এ দিন বাঁকুডা জেলার কয়েকটি সরকারি দফতর ঘুরে দেখা গিয়েছে, অন্য দিনের তুলনায় বরং এই বন্ধের দিনেই কর্মীদের বেশি ভিড় দেখা গিয়েছে। এক সরকারি কর্মীর মন্তব্য, ‘‘বাড়িতে কাজের জন্য ক’টা দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্য সরকার যেহেতু এ দিন হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ি করছে, তাই আর বাড়িতে থাকার ঝুঁকি নিলাম না। কী জানি, যদি বিরোধী বলে ছাপ পড়ে যায়!’’ সে কথা শুনে শাসকদলের প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠনের এক নেতার প্রতিক্রিয়া— ‘‘এ দিন প্রায় সবাই হাজিরা দিয়েছেন। সবাই ‘ফুলমার্কস’ পেয়েছেন।’’
হাতখালি
টানা দু’দিন বন্ধ থাকার পরে সোমবার ব্যাঙ্ক খুলতেই গ্রাহকদের লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছিল। কেউ বাতিল হওয়া নোট জমা করতে এসেছিলেন, কেউ আবার টাকা তুলতে। নোট বাতিলের বিরোধিতাতেই এ দিন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। টাকা তুলতে মাচানতলা মোড়ের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে দাঁড়ানো বাঁকুড়ার সতীঘাট এলাকার বাসিন্দা জগন্নাথ দে-র ধর্মঘট নিয়ে প্রতিক্রিয়া, “নোট বাতিলের ধাক্কায় হাতে টাকার জোগান নেই। সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এই সময় ধর্মঘট করে বাড়িতে বসে থাকলে কী আর পেট ভরবে?’’
ইসস্
বন্ধ ডাকলেই রাস্তাঘাটে লোক কম, গাড়ি কম, বাজারে বেচাকেনাও কম। এমন ছবিই দেখে এসেছে ঝালদা পুরশহর। যদিও ঝালদা পুরশহরের রাজনীতির পালাবদল হয়ে গিয়েছে। এই প্রথমবার পুরসভার ক্ষমতা দখল করেছে তৃণমূল। তাতেই এ বার বামেদের ডাকা হরতালে ঝালদার বন্ধ-ছবি পাল্টে গিয়েছে। পুরসভার কাজকর্ম ছিল স্বাভাবিক। পুরপ্রধান সুরেশ অগ্রবালের দাবি, ‘‘মানুষ বন্ধ চাইছেন না। পুরসভা অহেতুক কেন বন্ধ হবে?’’ স্বাভাবিক ছিল যান চলাচলও। জমজমাট ছিল ঝালদা বাজারও। মাছ ব্যবসায়ী ঝালদার বাসিন্দা সঞ্জীব সিংহ দেও-এর বাজারে এসে আক্ষেপ, ‘‘বন্ধের জন্য এ দিন মাছ কমই তুলেছিলাম। কিন্তু বাজারে এসে দেখি অন্যদের বেচাকেনা ভালই চলছে। আফশোস হচ্ছে, আরও মাছ তুললেই ভাল হতো।’’
বন্ধেও কাজ
মাস পাঁচেক আগে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ছেলের জন্ম হয়েছে। কিন্তু জন্মের শংসাপত্রই এতদিন আনতে যেতে পারেননি আড়শার তুম্বা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর অসিত মাহাতো। নোট অচলের জেরে কাজ-কারবার এখন বন্ধ। তাই সকালেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। শংসাপত্র হাতে পেয়ে তিনি তাজ্জব। বলেই ফেললেন, ‘‘ভাবছিলাম বন্ধের দিনে সরকারি অফিসে কাজ হবে তো? এসেই ওটা পেয়ে যাব ভাবতে পারিনি। ধারণাটাই বদলে গেল। বুঝলাম বন্ধেও কাজ হয়।’’
তথ্য: প্রশান্ত পাল, সমীর দত্ত, শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও
রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।