ঐতিহ্য: আলপনা। নিজস্ব চিত্র
সময়-পরিবেশ পাল্টে গিয়েছে অনেকটাই। হালের সেই ছোঁয়া এড়িয়ে আজও অধিকাংশ পরিবারে টিকে রয়েছে পৌষ আগলানোর উৎসব। ওই উৎসব পালনের জন্য শনিবার সকাল থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে যায়। উৎসব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিবারের মহিলারা হিমসিম খেয়ে যান। কিন্তু, পরিবারের সমৃদ্ধি কামনায় বছরের পর বছর তাঁরা হাসিমুখে ওই ধকল সহ্য করে চলেছেন।
প্রচলিত রয়েছে, ‘পৌষমাস লক্ষ্মীমাস’। এই সময়ই চাষিদের বাড়িতে ধান ওঠে। সমৃদ্ধির মুখ দেখে পরিবার। শুধু জমি মালিকেরাই নন। ধান তোলা-ঝাড়াই বাছাই সহ ন্যান্য কর্মসংস্থানের সুবাদে জমিহীনরাও কিছুটা স্বাচ্ছ্বল্যের মুখ দেখেন। বিশেষত, এই সময়ই ধান-চালের দাম তুলনামূলক হারে কিছুটা কম থাকায় হতদরিদ্র পরিবারের মানুষজনও তাঁদের সন্তানদের পাতে ভরপেট ভাত দিতে পারেন। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই পৌষমাস সবার আদরের মাস। সবাই চান বারোমাসই যেন পরিবারে পৌষের সমৃদ্ধি থাকে। তাই ওই রীতির মাধ্যমে লক্ষ্মীমাসের বন্দনা করেন পরিবারের মহিলারা।
এখন উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, সেচের সংস্থান-সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার জন্য বছরে একাধিক বার ধান ওঠে চাষি পরিবারে। সেই সুবাদে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। তবুও আদর কমেনি পৌষের। আজও মহিলারা হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে পৌঁষ আগলান। পরিবারের আধুনিকতা মলিন করতে পারেনি ওই উৎসব।
কেমন সেই উৎসব? কেমনই বা তার প্রস্তুতি? সকাল থেকেই গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো হয় উঠোন। বাড়ির বাইরেও ছেটানো হয় গোবর জল। তারপর হরিমন্দির-সহ বাড়ির প্রায় সর্বত্র আলপনা আঁকেন মহিলারা। দিনভর বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে জোগাড় করা হয় বকনা গরুর গোবর, ধান-দুর্বা, সিঁদুর, ছোট ছোট খড়ের আঁটি, সরষে–গাঁদাফুল সহ আরও নানা উপকরণ। রাতে সবার খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হয় পৌঁষ আগলানো। পাট ভাঙা কাপড় পড়ে মহিলারা প্রথমে বাড়ির সদর দরজার মুখে বসে গোবর দিয়ে গোলাকার পৌষবুড়ি তৈরি করেন। পৌষবুড়ির উপরে ধান-দুর্বা সহ অন্য উপকরণ দিয়ে শুরু হয় পৌষ আগালনো।
সুর করে মহিলারা একসঙ্গে ছড়ার মতো বলেন, ‘এসো পৌষ, বসো পৌষ না যেও ছাড়িয়ে/ ছেলেমেয়ে ভাত খাবে, সোনার থালা ভরিয়ে। কোথাও বলা হয়। ‘পৌষমাস লক্ষ্মীমাস যাইও না ছাড়িয়ে/ ছেলেপিলেকে ভাত দেব থালা ভরিয়ে।’ এরপর একই ভাবে গোয়ালঘর, রান্নাঘর এবং ঠাকুরঘরেও পৌষ আগলানোর রীতি প্রচলিত আছে। তারপর সদর দরজা থেকে ঠাকুরঘর পর্যন্ত উলুধ্বনি সহ জলের ধারা পৌঁছে দেওয়ার পরই শেষ হয় পৌষ আগলানোর পর্ব।
কোথাও কোথাও অবশ্য এ দিন ভোরে পুকুরে তিন ডুব দিয়ে পৌষ আগলানোর রীতিও প্রচলিত আছে। কিন্তু, পৌষ আগলানোর অন্তর্নিহিত মূল সুরটি সর্বত্র একই বলে মনে করেন নানুরের পরোটার ৮০ বছরের অন্নপূর্ণা হাজরা, কীর্ণাহার স্টেশনপাড়ার ৮৪ বছর মিনতি দাসেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের জমিজমা নেই। কিন্তু, এক সময় শাশুড়ির সঙ্গে পৌষ আগলেছি। আজও বৌমাদের নিয়ে পৌষ আগলে চলেছি। জমিজমা থাক বা না থাক। পৌষমাসে সাধারণত কারও অভাব থাকে না। পৌষকে আগলে রাখলে সারাবছই একই অবস্থা বজায় থাকে। সেই বিশ্বাসেই পৌষ আগলে চলেছি।’’
একই প্রতিক্রিয়া সিউড়ির দমদমার প্রতিভা ঘোষ, লাভপুরের অনুসূয়া মণ্ডলদেরও। তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের পরিবারে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। ডাইনিং টেবিল থেকে ‘পার্টি কালচার’ রয়েছে। তারপরেও আমরাও প্রচলিত বিশ্বাসেই আজও শীত উপেক্ষা করে পৌষ আগলাই।’’
এ দিন অধিকাংশ পরিবারে পিঠে-পুলি তৈরি নিয়েও মহিলাদের ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। লাভপুরের ফিংতোরের পার্বতী পাল, মিনতি পালরা জানান, পৌষমাস পিঠেপুলিরও মাস। শনিবারই শেষ পৌষ। তাই বিকেল থেকেই নানা ধরণের পিঠেপুলি তৈরি করেন। তারপর অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেন, ‘‘লোকের পৌষ এক মাস/ আমার পৌষ বারো মাস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy