Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রশাসনের আশ্বাস সত্ত্বেও ভোটে গোলমাল দুই জেলায়

বুথেই গুলি, জখম ২

এ দিন মূল অশান্তিটাই হয়েছে রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকায়। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসকদলের লোকজন মহকুমা এলাকার অন্তত কুড়িটি বুথের দখল নিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে।

দিনভর: মদনডির গোপালগঞ্জ বুথের সামনে ভোটকর্মীদের পোড়া গাড়ি। নিজস্ব চিত্র

দিনভর: মদনডির গোপালগঞ্জ বুথের সামনে ভোটকর্মীদের পোড়া গাড়ি। নিজস্ব চিত্র

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও প্রশান্ত পাল
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ০২:২০
Share: Save:

বুথের সামনে গুলি লাগল ভোটারের গায়ে। ফাটল বোমা। মনোনয়ন পর্ব মোটের উপরে ভালয় ভালয় পার করেছিল পুরুলিয়া। কিন্তু ভোটের দিনে ছবিটা গেল উল্টে। এ দিন মূল অশান্তিটাই হয়েছে রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকায়। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসকদলের লোকজন মহকুমা এলাকার অন্তত কুড়িটি বুথের দখল নিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। তবে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। রঘুনাথপুরের বাইরে বড় গোলমাল হয়েছে ঝালদার বাঘমুণ্ডিতে। রাতে জেলাশাসক জানান, পাঁচটি বুথে পু্নর্নির্বাচন হবে।

রঘুনাথপুর ২

সোমবার দুপুরে রঘুনাথপুর ২ ব্লকের নীলডি গ্রামের বুথে গুলিতে জখম হন এক ভোটার। বিজেপি ওই ব্যক্তিকে তাদের সমর্থক বলে দাবি করেছে। সেখানেই লাঠির আঘাতে মাথায় চোট পেয়েছেন নীলডি পঞ্চায়েতের তৃণমূলের বিদায়ী উপপ্রধান বাবলু মণ্ডল।

জখম ভোটারের নাম মনোজিৎ মণ্ডল। নীলডি হাইস্কুলে বুথ হয়েছে। স্কুলের পাশেই তেলেভাজার দোকান রয়েছে মনোজিতের। তাঁর দাবি, ভোটার কার্ড পকেটে নিয়ে সকালে দোকানে এসেছিলাম। দুপুর ২টো নাগাদ বুথ ফাঁকা দেখে ভোট দিতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাঁচ-ছ’টা গাড়ি এসে থামে। গামছায় মুখ বাঁধা দশ-পনেরো জন নেমে এলোপাথাড়ি বোমা ছুড়তে থাকে। গুলি চলে। মনোজিৎ বলেন, ‘‘ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা! কোনও মতে ঘরে পৌঁছই। দেখি রক্ত ঝরছে।’’ বিজেপির দাবি, তাঁদের কর্মী সমর্থকেরা পাল্টা প্রতিরোধ করেন। ঢিল, পাথর ছুড়তে শুরু করায় দুষ্কৃতীরা পালায়। পালানোর সময়ে দুষ্কৃতীদের একটি গাড়িও উল্টে যায়।

গন্ডগোলে জখম হয়েছেন নীলডি পঞ্চায়েতের বিদায়ী উপপ্রধান তৃণমূলের বাবলু মণ্ডলও। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি বাইরে থেকে লোক এনে বুথ দখল করে ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমাদের কর্মীরা প্রতিরোধ করেন। ওরা তখন লাঠি দিয়ে মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়।’’ মনোজিৎ এবং বাবলু দু’জনকেই রঘুনাথপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

নতুনডি পঞ্চায়েতের কলাগড়া গ্রামে তৃণমূলের কর্মীরাই সকাল থেকে বুথের দখল নিয়ে অবাধে ছাপ্পা মারে বলে অভিযোগ বিজেপির। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দিনের শেষে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুনডি পঞ্চায়েতের ৭৬ নম্বর বুথে পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

নিতুড়িয়া

বিকেল পৌনে ৪টে নাগাদ নিতুড়িয়ার জনার্দনডি পঞ্চায়েতের মদন়ডি প্রাথমিক স্কুলের বুথে সুজয় হাজরা নামে এক জনের হাতে গুলি লাগে। বিজেপি তাঁকে নিজেদের সমর্থক বলে দাবি করেছে। বিজেপির অভিযোগ, পাঁচ-ছ’টা গাড়িতে বহিরাগতরা বুথে এসে ছাপ্পা দিচ্ছিল। বিরোধী কর্মী সমর্থকেরা একজোট হয়ে প্রতিরোধ করলে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালায়। তখনই সুজয়ের হাতে গুলি লাগে। তাঁকে প্রথমে নিতুড়িয়া হারমাড্ডি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরে আসানসোলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিরোধী দল এবং উত্তেজিত গ্রামবাসীর একাংশ বুথের ভিতরে ঢুকে ব্যালট বাক্স ভেঙে দেন। বুথের বাইরে থাকা ভোটকর্মীদের দু’টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। খবর পেয়ে রঘুনাথপুর থেকে আসে দমকলের একটি ইঞ্জিন। নিতুড়িয়া থানার পুলিশ যায়। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করার দাবি ওঠে। বিকেল ৫টার পরে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক অবরোধ হয়। নতুনডি কলাগড়া হাইস্কুলের বুথও দখল করে বিরোধী পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সড়বড়ি পঞ্চায়েতের বেণীপুর গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের বুথে সশস্ত্র বহিরাগতরা ঢুকে ছাপ্পা দেয় বলে অভিযোগ। এর পরেই একদল লোক ওই বুথ থেকে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। পরে একটি পুকুর থেকে বাক্সটি পুলিশ উদ্ধার করেছে। তৃণমূলের অভিযোগ, তাদের দলের ভোট বেশি পড়ছে দেখে বিজেপি ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে। বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, তৃণমূল ছাপ্পা দিতে এসে সুবিধা না করতে পেরে ব্যালট বাক্স লুট করে।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত নিতুড়িয়ার সেক্টর থেকে ভোট গ্রহণের সামগ্রিক নথি জেলায় পৌঁছয়নি। ফলে বেণীপুর এবং জনার্দনডি পঞ্চায়েতের গোপালগঞ্জে ফের ভোট হবে কি না সেই বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তীর অভিযোগ, আসানসোল থেকে লোক নিয়ে এসে শাসকদল রঘুনাথপুর ২ এবং নিতুড়িয়ার ওই বুথগুলিতে সন্ত্রাস চালিয়েছে। বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্বের অভিযোগ, সকাল থেকেই সাত-আটটি গাড়ি বিভিন্ন বুথে ঘুরে বেড়ায়। পোলিং এজেন্টদের ভয় দেখানো হচ্ছিল। পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কাজ হয়নি। কিন্তু কাজ না হওয়ায় দুপুরে বোমা-বন্দুক নিয়ে বুথে চড়াও হয়। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউড়ি বলেন, ‘‘রঘুনাথপুরে আমাদের সংগঠন যথেষ্ট মজবুত। জনভিত্তিও রয়েছে। বাইরে থেকে লোক এনে ঝামেলাটা বিরোধীরাই পাকিয়েছে। আমাদের কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন।’’

বাঘমুণ্ডি

বাঘমুণ্ডির মাঠা জুনিয়র হাইস্কুলের বুথে অশান্তির জেরে ভোট বানচাল হয়ে যায়। জায়গাটা অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে। ওই বুথের এক বিরোধী দলের এজেন্ট বলেন, ‘‘দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ বেশ কিছু লোকজন বুথের ভিতরে ঢুকে পড়ে। গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা। পোলিং অফিসারদের থেকে ব্যালট ছিনতাই করে নেয়। হুমকি দিয়ে আমাদের সবাইকে চুপচাপ বসে থাকতে বলে। ছাপ্পা দিয়ে বেরিয়ে যায়।’’

বাঘমুণ্ডির বিধায়ক নেপাল মাহাতোর বক্তব্য, প্রশাসনকে এই ঘটনার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু পদক্ষেপ না হওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ব্যালট বাক্স বার করে এনে পুড়িয়ে দেন। একই অভিযোগ বিজেপি ও সিপিএমেরও। তৃণমূলের বাঘমুণ্ডির কোর কমিটির সদস্য শম্ভুনাথ দাস অবশ্য বলেন, ‘‘শান্তিতে ভোট চলছিল। কংগ্রেস, বিজেপি আর সিপিএমের লোকজন মিলে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয়।’’ জেলাশাসক জানিয়েছেন, ওই বুথে এ দিনের ভোট বাতিল করা হয়েছে। পুনরায় ভোট নেওয়া হবে।

মাঠার কিছুটা দূরে ধনুডির বুথেও অশান্তি হয়েছে। মাঠার গোলমালের খবর সেখানেও পৌঁছয়। বিজেপির অভিযোগ, সেখানে তাঁদের পোলিং এজেন্টদের বের করে ছাপ্পা দেওয়া চলছিল। পুলিশকে বলেও কাজ হচ্ছিল না। উল্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে তাঁদের পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থীকে আটক করে। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে বিজেপি কর্মীরা প্রতিবাদ শুরু করেন। বহিরাগতরা সরে পড়ে। নেপাল মাহাতোর দাবি, গোলমাল চলাকালীন সেখানে অবজার্ভার পৌঁছন। তাঁকে ঘিরে শুরু হয় বিক্ষোভ। গাড়ি লক্ষ্য করে ইটও ছুটে আসে। অবজার্ভারের সঙ্গে থাকা পুলিশ কর্মীরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। জেলাশাসক জানিয়েছেন, ওই বুথে গোলমালের জন্য কিছু ক্ষণের জন্য ভোট নেওয়া বন্ধ ছিল। পরে ফের চালু হয়।

কাশীপুর

বিরোধীদের অভিযোগ, বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়ার নেতৃত্বে এ দিন কাশীপুরে বিরোধী কর্মী, সমর্থক এবং পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। বিধায়কের নেতৃত্বে বিভিন্ন বুথ থেকে পোলিং এজেন্টদের বার করে ছাপ্পা দেওয়া হয়। আদ্রার সুভাষনগরের দু’টি বুথে বহিরাগতরা মোটরবাইকে গিয়ে ছাপ্পা দেয় বলে অভিযোগ। সিপিএম প্রার্থী সুপ্রিয়া দত্ত ও কাজল ভট্টাচার্যের দাবি, প্রশাসনের কাছে এই অভিযোগ জানিয়েছেন।

পাড়া

সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীননাথ লোধার অভিযোগ, পাড়ার ঝাপড়া-জবড়রা পঞ্চায়েতের চারটি বুথ থেকে পোলিং এজেন্টদের বার করে দেওয়া হয়। ওই ব্লকেরই হরিহরপুর গ্রামে গোলমালের চেষ্টা তাঁরা প্রতিরোধ করেন বলে দাবি। হরিহরপুরেরই একটি বুথ থেকে কিছু ব্যালট সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সিপিএম এবং তৃণমূল পরস্পরের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, হরিহরপুরের ১০৩ নম্বর বুথে ফের ভোটের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ওই ব্লকেরই চালুনিয়া গ্রামের ৭১ নম্বর বুথে পুনর্নির্বাচনের প্রস্তাব গিয়েছে।

ঝালদা

ঝালদা ১ ব্লকের হুসেনডি গ্রামের একটি বুথে এ দিন বিকেলে বোমাবাজি হয় বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ৫টার পরে ভোট শেষ হয়। তখনও যাঁরা লাইনে ছিলেন, তাঁদের স্লিপ দেওয়া হচ্ছিল। সেই সময়ে বাইরে বোমাবাজি হয়। হুসেন আহমেদ নামে বুথের বাইরে এক জন জখম হন। তাঁকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়েছে।

কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা নেতৃত্বের অভিযোগ, অবজার্ভারদের একাধিক বুথে অশান্তির কথা জানানোই সার হয়েছে। কোনও সমাধান হয়নি। কাশীপুরের এক বিজেপি প্রার্থী বলেন, ‘‘রবিবার রাতে বহিরাগতরা বুথে দখল নিচ্ছে বলে অবজার্ভারকে ফোনে অভিযোগ করেছিলাম। শুনে উনি বিডিওকে বলার পরামর্শ দেন।’’ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘লিখিত ভাবে অবজার্ভারকে জানিয়েছিলাম, বাঘমুণ্ডিতে বহিরাগতরা ঢুকে ভোট লুট করার চেষ্টা করছে। তার পরেও কোনও পদক্ষেপ হয়নি।’’ অবজার্ভারদের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি জেলাশাসক।

দিনের শেষে শাসকদলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা। বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা আগেই বলেছিলাম বাইরে থেকে অশান্তি পাকাতে লোক আনছে তৃণমূল। সেটাই হল।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায় বলেন, ‘‘কোনও প্রতিবাদেই কোনও কাজ হয়নি। ভোটের নামে প্রহসন হলো।’’ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় আগে এই অশান্তির সংস্কৃতি ছিল না। সেটা কেন হল, শাসকদলের জবাবদিহি করা দরকার।’’

তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো অবশ্য বলেন, ‘‘ভোট শান্তিতেই হয়েছে। কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত গোলমাল হয়েছিল। তাতে আমাদের কর্মী সমর্থকেরা কোনও ভাবে যুক্ত নন। গোলমালের ব্যাপারটা প্রশাসনই দেখছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Elections 2018 Violence Shot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE