Advertisement
E-Paper

আঁধার কাটিয়ে ফেরার লড়াই

চার দিকে অন্ধকার। সম্বল বলতে অনুভূতির আলো। সাদা কাগজে পিন ফোটানো সাংকেতিক অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের আঙুলের ডগা। শব্দযন্ত্র থেকে পাঠ্য বিষয় মর্মে ঢুকে যাচ্ছে গুটিকয়েক ছাত্রের।

তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১৬
অরবিন্দ ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নবিরুলরা। নিজস্ব চিত্র।

অরবিন্দ ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নবিরুলরা। নিজস্ব চিত্র।

চার দিকে অন্ধকার। সম্বল বলতে অনুভূতির আলো। সাদা কাগজে পিন ফোটানো সাংকেতিক অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের আঙুলের ডগা। শব্দযন্ত্র থেকে পাঠ্য বিষয় মর্মে ঢুকে যাচ্ছে গুটিকয়েক ছাত্রের।

এ ভাবেই নিভৃতে চলছে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধক চার ছাত্রের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি। সিউড়ির অরবিন্দ ইনস্টিটিউট ফর সাইটলেস স্কুলের হস্টেলে একবুক সাহস নিয়ে চলছে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। সামনে মাধ্যমিক। বড় লড়াই।

শেখ নবিরুল। বাড়ি চৌহাট্টায়। বাবা দিনমজুর। তিন ভাইবোন। মাত্র দু’বছর বয়সে সারা পৃথিবীর আলো মুছে যায় তার। “গ্রামের স্কুলে পাঁচ ক্লাস অবধি পড়া শেষ করে এখানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই। নতুন করে পড়া শুরু করি। ক্লাস ওয়ান ছ’মাস, ক্লাস টুও ছ’মাস, ক্লাস থ্রির পড়া এক বছরে শেষ করে ফেলি। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের জন্য বিশেষ পড়ার ব্যবস্থাটাকে রপ্ত করে ফেলতে আর অসুবিধা হয়নি,”—বলছে আত্মপ্রত্যয়ী নবিরুল। সাঁইথিয়া থানার নানুবাজারের আর এক দিনমজুর হুফনা হেমব্রমের ছেলে সোমনাথ হেমব্রম। গ্রামের স্কুলে পাঁচ ক্লাস অবধি পড়ে একই নিয়মে সে-ও লড়াইয়ে নেমেছে। তার কথায়, “মাত্র দু’মাস বয়সে আমি দৃষ্টিশক্তি হারাই। প্রথমে গ্রামেই পড়তাম সাধারণ নিয়মে। তার পরে ব্রেইলের মাধ্যমেই পড়ি। সাদা কাগজে পিন ফোটানো ফুটোতেই সব বিষয় পড়ি।”

আর এক ছাত্র সীতারাম মাঝি জানায়, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে আসে এই বিশেষ বই। পাশাপাশি কলকাতার হেনা বসু সোসাইটি ফর ভিস্যুয়াল হ্যান্ডিক্যাপ্ট থেকে আসে রেকর্ড করা পেন ড্রাইভ। যেগুলি ছোট সাউন্ড বক্সে বাজিয়ে সিলেবাসের বিষয়বস্তু কানে শুনে মনে রাখে পড়ুয়ারা। পুরুলিয়ার জয়পুর থানার বনগড়া গ্রামের গরিব চাষি পরিবারের ছেলে সীতারাম জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। প্রথমে পুরুলিয়া, তার পরে উত্তরপাড়া হয়ে সব শেষে সিউড়িতে ঠাঁই নিয়েছে সে। আবার পেশায় পুরোহিতের ছেলে বিবেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরুলিয়ার বলরামপুরের হেতাডী গ্রামে বাড়ি। সে বলে, “ক্লাস ফাইভ অবধি এক চোখে দৃষ্টি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। তার পর দু’চোখের সামনে অন্ধকার। সীতারামের মতোই আমিও উত্তরপাড়া হয়ে এই স্কুলে আসি।” ক্লাস এইট অবধি প্রত্যেকেই ব্রেইল পদ্ধতিতে ক্লাস পরীক্ষা দিয়েছে। তার পরে ক্লাস নাইন ও টেনে রাইটারের সাহায্যে। ট্রেলার ফ্রেমে অঙ্ক কষে আইপি স্লেটে তা লিখতে হয়। কখনও আবাকাস পদ্ধতির সাহায্যেও অঙ্ক করতে হয়।

এতো গেল অনুশীলনের কথা। অরবিন্দ ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক উজ্জ্বল সিংহ জানান, ওই পড়ুয়ারা নবম শ্রেণিতে সিউড়ির শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়। রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। পড়াশোনা চলে এই স্কুলেই। বিদ্যাপীঠের ছাত্র হয়েই তারা পরীক্ষা দেয়। বিদ্যাপীঠের শিক্ষকেরা যে এই পড়ুয়াদের প্রতি কতটা আন্তরিক, তা বোঝা গেল নবিরুলদের কথায়। স্থানীয় চন্দ্রগতি হাইস্কুলের তরফে একতলার আলাদা ঘরে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। রাইটার আসে বীরভূম জেলা স্কুল থেকে। বিবেকদের সব সময়ের সঙ্গী হস্টেল সুপার সৌমেন্দু সেনগুপ্ত ছাত্রদের এই লড়াইয়ের অন্যতম উৎসাহদাতা। তিনি বলছেন, “মাসুদার রহমান ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে পারলে এই সামান্য পরীক্ষায় ওরা সফল হবেই।”

সাধারণ পড়ুয়াদের থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট বেশি সুযোগ মেলে। জীবনের প্রথম পরীক্ষার আগে তাই রাতভর পরিশ্রম করে চলেছে নবিরুল, বিবেক, সীতারাম, সোমনাথরা। তাদের শুধু একটিই আবেদন, “আমাদের একটু আর্শীবাদ করবেন, যাতে লড়াইয়ে জিততে পারি।”

Blind students Madhyamik Examination
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy