দুর্ঘটনার পরে। এ ভাবেই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে সরকারি বাস।
দুরন্ত গতিতে মুখোমুখি ছুটে আসছিল সরকারি বাস আর দশ চাকা ট্রাক দু’টো। গাড়ির দু’টোর মধ্যে ব্যবধান তখন মেরেকেটে কুড়ি কি বাইশ মিটার। ঠিক সেই সময় দু’টো গাড়ির মাঝে কোনও ভাবে ঢুকে পড়েছিল একটা মোটরবাইক। সেই মোটরবাইককে জায়গা করে দিতে গিয়েই ঘটে গেল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যু হল চার জনের। জখম হলেন বাসযাত্রী, ট্রাক চালক, খালাসি মিলিয়ে অন্তত ১৩ জন।
মঙ্গলবার সকাল এগারোটা নাগাদ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে দুবরাজপুর থানা এলাকার জয়দেবের মোড় সংলগ্ন একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে, পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কে। পুলিশ সূত্রের খবর, মৃতদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি বাসের চালক দেবাশিস সরকার (৫৫), মোটরবাইক আরোহী তারিকুল শেখ (২৪), বাসযাত্রী সাথী হাজরা (১৮)। অন্য এক বাসযাত্রীর পরিচয় রাত পর্যন্ত জানতে পারেনি পুলিশ। দেবাশিসবাবুর বাড়ি বাঁকুড়ার বড়জোড়া থানা এলাকার পখন্ন্যায়। সাথীর পানাগড়ে। মোটরবাইক আরোহী তারিকুল সদাইপুর থানা এলাকার জামথলিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
পুলিশ সূত্রের খবর, বহরমপুর থেকে দুর্গাপুরগামী একটি বাস সকাল ১১টা নাগাদ ওই রাস্তা ধরে যাচ্ছিল। এমনিতেই ওই রাস্তায় যথেষ্টই ভারি যানবাহন চলাচল করে। দুর্ঘটনাও লেগেই থাকে। রাস্তা ভাল হওয়ার সুবাদে এ দিন গাড়ি দু’টিও দুরন্ত গতিতে ছুটছিল। মাঝে ঢুকে পড়ে মোটরবাইকটি। তারিকুল সেটি চালাচ্ছিলেন, পিছনে বসেছিলেন তাঁর এক আত্মীয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ট্রাকের পাশ কাটিয়ে বাসটির সামনে চলে আসে মোটরবাইকটি। দু’টি গাড়ির চালকই চেয়েছিলেন মোটরবাইক আরোহীদের বাঁচাতে। শেষরক্ষা হয়নি। বাসের ধাক্কায় মাঠের মধ্যে ছিটকে পড়েন তারিকুল ও তাঁর আত্মীয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বাস চালক-সহ দুই যাত্রীর। প্রথমে স্থানীয় বাসিন্দা, পরে পুলিশে এসে মৃত ও আহতদের উদ্ধার করে দুবরাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ও সিউড়ি জেলা হাসাপাতালে পাঠায়। সিউড়ির পথে মৃত্যু হয় তারিকুলের।
জখমদের দেখতে সিউড়ি হাসপাতালে বিজেপি প্রার্থী জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র
দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা মৃণাল ঘোষ। দুবরাজপুর হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মৃণাল জানালেন, সকাল ৭টা ২০ নাগাদ বহরমপুর থেকে বাসে উঠেছিলেন। গন্তব্য ছিল দুর্গাপুর। সিউড়ি পৌঁছে কিছুক্ষণ থেমে দশটা নাগাদ ফের রওনা হয় বাস। তিনি বসেছিলেন ডান দিকের জানলার পাশে। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগল! ছিটকে গেলাম। কার, কোথায় লেগেছে, কী হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারিনি। একটু সামলে নিয়ে দেখি সহযাত্রীদের কারও চোখ ফেটে রক্ত ঝড়ছে! তো কারও মাথা ফেটেছে।’’ তিনি বলে চলেন, ‘‘যাঁরা একটু সুস্থ ছিলেন বলছিলেন একটি মোটরবাইক সামনে চলে আসায় এমন ঘটনা।’’
প্রায় একই রকম অনুভূতি পানাগড়ের তরুণী কস্তুরিকা মণ্ডলের। দিন কয়েকের জন্য মুর্শিদাবাদের মধুপুরে মামার বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফিরছিলেন বাসে। চোখের পাশে এবং মাথায় চোট লেগেছে। দুবরাজপুর হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বললেন, ‘‘কন্ডাক্টরের পিছনের দিকের সিটে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রচণ্ড শব্দ! সামনের সিটে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। জোর ভাগ্য বেঁচে গিয়েছি।’’
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, সংঘর্ষের তীব্রতায় বাস ও ট্রাকের সামনের অংশ কার্যত গুঁড়িয়ে গিয়েছে। জানা গেল, দুর্ঘটনার পরে প্রথমে দশ জনকে দুবরাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। পরে দুবরাজপুর থেকে সাত জনকে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সিউড়ি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দুবরাজপুর থেকে রেফার হয়ে এবং আলাদা ভাবে মোট ১০ জন চিকিৎসাধীন। তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ দিনের দুর্ঘটনার জেরে ওই রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ক্রেনে করে বাসটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। উদ্ধারের কাজে এবং যান চালাচল স্বাভাবিক রাখতে ইলামবাজার ও দুবরাজপুর থানার পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও। প্রথমে উদ্ধারে হাত লাগান স্থানীয় শেখ কুরবান, তাপস ঘোষ, হাফিজুর রহমানরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy