Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
Coronavirus

কেউ জ্বরে পড়ল কি, উদ্বেগে ওঁরা

পুরুলিয়া জেলায় লড়াইটা আরও বেশি। সেখানে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৫৭
Share: Save:

ভিন্‌ রাজ্য থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোকজন এসে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছেন। আর রোজ তাঁদের খোঁজখবর রাখতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা দু’জেলার আশাকর্মী এবং এএনএম-দের (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফারি)। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে গিয়ে ওলটপালট তাঁদের পারিবারিক জীবন। তাঁদের গুরুত্বের কথা মানছেন করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় কাজ করা প্রশাসনের আধিকারিকেরাও। পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলা জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতর, পুলিশ ও প্রশাসন একটা দল হিসেবে কাজ করছি। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলেন আশাকর্মী ও এএনএম-রা।’’

বড়জোড়ার সরালির উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের এএনএম সহেলি সুলতানার বাড়ি হাটআশুরিয়ায়। বাড়িতে তাঁর দু’বছরের মেয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘কাজ থেকে ফিরলেই মেয়েটা ছুটে আসে। আমার ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করে। এখন বাড়ির বাইরে ব্যাগ লুকিয়ে রাখি। কোনও রকমে ওকে এড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়তে হয়। ওকে নিয়ে খুব চিন্তা।

তিনি জানান, তার থেকেও চিন্তা হোম কোয়রান্টিনে থাকা লোকেদের নিয়ে। তাঁরা কেউ বাইরে বেরোচ্ছেন কি না, সব সময়ে তা নিয়ে চিন্তায় থাকি।তবে এটা ভেবেই মনে শান্তি পাচ্ছি যে শুধু চাকরি নয়, দেশের জন্য বড় লড়াই করছি।’’

বাড়িতে ছ’বছরের ছেলে আর দশ বছরের মেয়ে রয়েছে বড়জোড়ার হরিরামপুরের আশা কর্মী মুনমুন ঘোষের। তিনিও জানান, একে সন্তানদের দেখতে পাচ্ছেন না। তার উপরে এলাকার কখন, কার জ্বর হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন। বড়জোড়ার হাটআশুড়িয়ার আশাকর্মী টুলু রায় জানান, গুজবের ঠেলায় তাঁরা অতিষ্ঠ হচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ কেউ ফোন করে জানাচ্ছেন, বাইরে থেকে আসা অমুকের জ্বর হয়েছে। খবর নিতে গিয়ে দেখি, তা ভুল। কিন্তু কানে কিছু এলে খোঁজ না নিয়ে উপায়ও নেই।’’ ইঁদপুরের ভেদুয়াশোল গ্রামের আশা কর্মী সোনালি পাত্র বলেন, ‘‘বাড়িতে বয়স্ক মানুষ আছে। কিন্তু ঘর নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?’’

পুরুলিয়া জেলায় লড়াইটা আরও বেশি। সেখানে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সকালেই বাড়িতে দেড় বছরের ছেলেকে ছেড়ে বেরোতে হচ্ছে ঝালদা ১ ব্লকের গড়িয়া গ্রামের আশাকর্মী বিপুলা মাহাতোকে।

তিনি জানান, দিনভর গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকা লোকজন আদৌও নিয়ম মানছেন কি না, তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। দুপুরে বাড়ি ফিরে যে ছেলেকে দেখবেন, সে অবকাশও তাঁর নেই। বিকেল হলেই আবার বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে এএনএম-দের সঙ্গে বৈঠক করতে। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরছেন বিপুলা।

তিনি বলেন, ‘‘গত দশ দিন ধরে ছেলেকে শুধু রাতের দিকে দেখাশোনা করতে পারছি। সারাটা দিন ছেলেটা মাকে কাছেই পাচ্ছে না।” ঝালদারই বাঁধডি গ্রামের আশাকর্মী লতিকা মাহাতো বলেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি বাড়ির লোকজন প্রতিদিন বেরোতে বারণ করছেন। কিন্তু উপায় নেই।’’

কী কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের? সূত্রের খবর, ভিন্‌ রাজ্য থেকে কেউ গ্রামে ফিরলেই তাঁদের সম্পর্কে বিশদে তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কেউ নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের উপসর্গ—জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগলে, তাঁর নাম-ঠিকানা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, চিকিৎসকেরা যাঁদের ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরা আদৌ তা মানছেন কি না, সেই নজরদারি মূলত করতে হচ্ছে এএমএম ও আশাকর্মীদেরই।

পাশাপাশি, গ্রামে ঘুরে বর্তমান পরিস্থিতিতে কী-কী স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তা বাসিন্দাদের বোঝাতে হচ্ছে।

কাশীপুরের আশাকর্মী অর্চনা খাঁ, রাধারানি পাত্রদের কথায়, ‘‘প্রতিদিনই ফোন করে গ্রামের বাসিন্দরা জানাচ্ছেন, ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকা লোকজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ছেন। ছুটে গিয়ে ওই পরিবারকে বোঝাতে হচ্ছে। কাজ না হলে এএনএম-দের মাধ্যমে ব্লক স্বাস্থ্য দফতর, না হলে পুলিশকে জানাতে হচ্ছে।’’

এত সব করতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। ইঁদপুরের জিড়রা গ্রামের আশাকর্মী বন্দনা চক্রবর্তী জানান, তাঁর বাড়িতে ষাটোর্দ্ধ স্বামী। এলাকায় চল্লিশ জন বাইরে থেকে এসেছেন। তার মধ্যে দু’জন যক্ষ্মার রোগী। কিন্তু বিনা গ্লাভস, ‘স্যানিটাইজ়ার’-এই তাঁকে লড়তে হচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে আশাকর্মী ও তাঁদের পরিবারের জন্যও মে মাস পর্যন্ত ১০ লক্ষ টাকা বিমা করার কথা ঘোষণা করেছেন। তাতেই কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন আশাকর্মী ও এএনএম-রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE